মহিলা সাংবাদিকদের বাদ দেওয়া বিতর্কে সাফাই দিলেন আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুতাক্কি...
আজকাল | ১৩ অক্টোবর ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: নয়াদিল্লিতে নারী সাংবাদিকদের বাদ দিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন নিয়ে তৈরি বিতর্কের পর, আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুতাক্কি রবিবার (১২ অক্টোবর) ফের সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে বিষয়টির সাফাই দিলেন। নারী সাংবাদিকদের সামনেই তিনি বলেন, “পূর্বের অনুষ্ঠানে মহিলা সাংবাদিকদের অনুপস্থিতি কোনো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল না, বরং স্বল্পসময়ের নোটিসের কারণে তা ঘটেছিল।”
দুইটি ইসলামিক এমিরেটের পতাকা পাশে রেখে মুতাক্কি বলেন, “এই বিষয়টিকে অযথা বাড়িয়ে দেখা হচ্ছে। এটি কেবলমাত্র সময়ের সীমাবদ্ধতার কারণে ঘটেছিল, এর বাইরে কিছু নয়।”
এর আগে শুক্রবার অনুষ্ঠিত প্রথম সংবাদ সম্মেলনে নারী সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সেই ঘটনার পর দেশ-বিদেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। বিরোধী দলগুলো ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের ভূমিকাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রক জানায়, ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন তারা করেনি এবং এতে তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না।
রবিবারের সংবাদ সম্মেলনটি পূর্বের তুলনায় বৃহত্তর পরিসরে অনুষ্ঠিত হয়। আগের দিনের তুলনায় এবার মঞ্চে এবং পেছনে তালিবান শাসনের প্রতীকী উপস্থিতি আরও স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে — মুতাক্কির সামনে টেবিলে ছোট একটি পতাকা এবং পেছনে বড় আকারের একটি ইসলামিক এমিরেটের পতাকা স্থাপন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনের প্রথম প্রশ্নই ছিল নারী সাংবাদিকদের বাদ দেওয়ার প্রসঙ্গে। উত্তরে মুতাক্কি বলেন, “আমরা কখনোই নারী সাংবাদিকদের বাদ দিতে চাইনি। অংশগ্রহণকারীদের তালিকা আগেই তৈরি ছিল এবং সময়ের অভাবে তা সংশোধন করা সম্ভব হয়নি। এটি পুরোপুরি প্রযুক্তিগত বিষয় ছিল।”
মুতাক্কির এই সফর ভারত-আফগান সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় চিহ্নিত করছে, কারণ এটি তালিবান সরকারের কোনো সিনিয়র মন্ত্রীর প্রথম সরকারি ভারত সফর। যদিও ভারত এখনো তালিবান সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর ঘোষণা করেছেন যে কাবুলে ভারতের ‘টেকনিক্যাল টিম’-এর স্তর “এম্ব্যাসি লেভেল”-এ উন্নীত করা হবে।
২০২১ সালের আগস্টে তালিবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করলে ভারত কাবুল থেকে সমস্ত দূতাবাস কর্মী সরিয়ে নেয় এবং আফগান নাগরিকদের দেওয়া ভিসাও বাতিল করে। সেই তুলনায় বর্তমান পদক্ষেপটি এক বড় কূটনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এক সাংবাদিক তালিবান সরকারের নারীদের উচ্চশিক্ষা বন্ধ রাখার নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুললে মুতাক্কি বলেন, “আফগানিস্তানে ১ কোটি শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ২৮ লক্ষই মেয়ে। তারা ধর্মীয় মাদ্রাসায় স্নাতক স্তর পর্যন্ত পড়তে পারে। কিছু এলাকায় কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, কিন্তু আমরা কখনোই শিক্ষাকে ‘হারাম’ ঘোষণা করিনি; এটি কেবল সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে।”
তবে নারীদের উচ্চশিক্ষার অধিকার রক্ষিত হয়নি বলে প্রশ্ন করা হলে মুতাক্কি সরাসরি জবাব না দিয়ে বলেন, “আমরা দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছি। গত ৪০ বছরে যা ঘটেছে, আমরা ক্ষমতায় এসে অনেক অপরাধীকেও ক্ষমা করেছি। আমিও কাবুলে মোটরসাইকেল চালাই কোনো নিরাপত্তা ছাড়াই।”
জাতিসংঘের আফগানিস্তানবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি রোজা ওতুনবায়েভা গত মাসে নিরাপত্তা পরিষদে সতর্ক করেছিলেন যে, ষষ্ঠ শ্রেণির পর মেয়েদের স্কুল বন্ধ থাকার কারণে “পুরো এক প্রজন্ম বিপদের মুখে।”
এদিন মুতাক্কিকে জিজ্ঞাসা করা হয়, নয়াদিল্লির আফগান দূতাবাস এখন কি তালিবান সরকারের নিয়ন্ত্রণে? উত্তরে তিনি বলেন, “এই দূতাবাস সম্পূর্ণভাবে ইসলামিক এমিরেটের নিয়ন্ত্রণে। যারা একসময় আমাদের বিরুদ্ধে লড়েছিল, তারাও আজ আমাদের সঙ্গে কাজ করছে।”
তবে সাংবাদিকরা উল্লেখ করেন, দূতাবাসের বাইরে এখনো আফগান প্রজাতন্ত্রের ত্রিবর্ণ পতাকা ওড়ানো হচ্ছে, আর মুতাক্কির পাশে রয়েছে সাদা-কালো তালিবান পতাকা। জবাবে মুতাক্কি বলেন, “আমরা এই পতাকার তলায় ‘জিহাদ’ করেছি, লড়েছি এবং জিতেছি। তাই এই পতাকাই আজ এখানে রয়েছে।”
বর্তমানে দূতাবাস পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন সাঈদ মোহাম্মদ ইব্রাহিমখিল, যিনি হায়দরাবাদের আফগান কনসাল জেনারেল ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে মুম্বাইয়ের সাবেক কনসাল জেনারেল জাকিয়া ওয়ারদাকও দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁরা দায়িত্ব নিয়েছিলেন সেই সময়, যখন প্রজাতন্ত্র-নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত এবং কূটনীতিকেরা ভারত সরকারের আচরণের প্রতিবাদে কার্যক্রম স্থগিত করেন।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের সম্মতিতেই এই পরিবর্তন ঘটে। যদিও উভয় কর্মকর্তা প্রজাতন্ত্র সরকারের অধীনে নিযুক্ত ছিলেন, তারা তালিবান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখেছিলেন।
তবুও দূতাবাসটি বর্তমানে এক ধরনের কূটনৈতিক অনিশ্চয়তায় রয়েছে। ভবনটি আইনি দিক থেকে আফগান পররাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে — যা এখন তালিবান পরিচালিত — কিন্তু ভারত এখনো তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে দূতাবাসের বাইরে পুরনো পতাকার উপস্থিতি প্রতীকীভাবে এই দ্বৈত পরিস্থিতিকেই প্রতিফলিত করছে।
এই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তালিবান একদিকে নিজেদের আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা প্রদর্শনের চেষ্টা করেছে, অন্যদিকে নারী অধিকার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে তাদের অবস্থান আবারও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।