কেশপুরে বারুদের গন্ধ এখন প্রাণ কাড়ে না, রঙিন করে কালীপুজো
বর্তমান | ১৩ অক্টোবর ২০২৫
রাজদীপ গোস্বামী, কেশপুর: একদা বারুদের গন্ধ কেড়ে নিত কেশপুরের প্রাণ। এখন সেই বারুদের গন্ধেই রঙিন হয় অমাবস্যার রাত! কেশপুরের বাজির কদর আজ রাজ্য ছাড়িয়ে ভিনরাজ্যেও।
গ্রামের নাম শীর্ষা। কেশপুরের প্রধান রাস্তার ধারে ছোট্ট গ্রাম। পাশ দিয়ে গেলে নাকে আসে বারুদের গন্ধ। মনে করিয়ে দেয় অশান্ত সময়ের সেই কেশপুরকে। তখন প্রায় প্রতিদিনই রাজনৈতিক হানাহানি। গোলাগুলি। বোমাবাজি। বোমা নাকি তৈরি হতো ঘরে ঘরে! গোলাবারুদ মজুত থাকত। অশান্ত এলাকায় ভেসে বেড়াত বারুদের গন্ধ। এখন অবশ্য কেশপুরে সেই বারুদের গন্ধে প্রাণহানির আশঙ্কা নেই। রয়েছে শিশু থেকে বুড়োদের অনাবিল আনন্দের রসদ। এটাও ‘বিজ্ঞানের আশীর্বাদ’-এর এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
সামনে কালীপুজো। ব্যস্ত শীর্ষা গ্রামের মাঝিপাড়া। ১২-১৫টি পরিবারের বাস পাড়ায়। তারাবাতি, তুবড়ি, রঙমশাল তৈরি চলছে ঘরে ঘরে। এবার চাহিদা তুঙ্গে। যোগান দিতে নাওয়া-খাওয়া ভুলেছেন কারিগররা। বাড়ির প্রায় সকলেই হাত লাগিয়েছেন বাজি তৈরিতে। ইতিমধ্যেই বিক্রিবাটাও বেশ ভালো। মুখে চওড়া হাসি কারিগরদের। তবে, টানা বৃষ্টি বিপাকে ফেলেছিল তাঁদের। এখন রোদ ঝলমলে আকাশ। জোরকদমে চলছে বাজি তৈরি। কারিগরদের কথায়, ‘বাজির তৈরির পর প্রখর রোদে রাখার প্রয়োজন। গুণমান ভালো হয়। এবার বৃষ্টিতে বেশ সমস্যা পড়েছিলাম। প্রচুর বাজি নষ্টও হয়েছে।’ এদিন বাড়ির উঠোনে বসে বাজি তৈরির কাজ করছিলেন কালীপদ খামরুই, উষা খামরুইরা। তাঁরা বলছিলেন, ‘এ বছর বিক্রি ভালোই হচ্ছে। অনেকেই গ্রাম থেকে বাজি কিনে নিয়ে গিয়ে বাজারে বিক্রি করছেন। বৃষ্টি না হলে খুবই সুবিধা হতো। তবে, এবছর বাজি তৈরির কাঁচামালের দাম অনেকেটাই বেড়েছে। মুনাফার অংক কিছুটা কমেছে।’
কেশপুর ব্লকের বেশিরভাগ গ্রামের মানুষ চাষের সঙ্গেই যুক্ত। কিছু গ্রামের লোকজন নানা জিনিস তৈরি করে রুজিরুটি চালাচ্ছেন। এখন আপাত শান্ত। আজকের কেশপুর আর সেই কেশপুরের বিস্তর ফারাক। রাজনীতি নির্বিশেষে সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছেন সব শ্রেণির মানুষ। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে পরিবারে। গ্রামবাসীরা বলছিলেন, ‘একসময় কেশপুরজুড়ে রাজনৈতিক সন্ত্রাস লেগেই থাকত। সেই সময় ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্পীদের নানা সমস্যার মধ্যে পড়তে হতো। বিভিন্ন জিনিস তৈরি করলেও ক্রেতাদের দেখা মিলত না। তবে গত কয়েক বছরে ছবিটা অনেক বদলে গিয়েছে।’ যেমন বদলে গিয়েছে বাজির গ্রাম শীর্ষা। গ্রামবাসীরা বলছেন, ‘মাঝি পাড়ার মানুষ বংশপরম্পরায় বাজি তৈরির কাজের সঙ্গে যুক্ত। প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ৩০ প্যাকেট শুধু তারা বাতি তৈরি করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন সাইজের তুবড়ি তৈরি করেন গ্রামের মহিলা কারিগররাও। আগে বাজি তৈরির মশলার দাম ছিল ১৫০ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৩০০ টাকার বেশি। স্থানীয় বাসিন্দা প্রদ্যুৎ পাঁজা বলেন, ‘বহু যুগ আগে থেকেই কালীপুজোতে বাজি ফাটানোর রীতি রয়েছে। অনেকেই কেশপুর থেকে বাজি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। সেই বাজি ফাটিয়ে আনন্দে মেতে উঠছেন সকলেই।’ কেশপুরে এখনও বাজি রয়েছে। বারুদের গন্ধ রয়েছে। কিন্তু, সেই গন্ধে প্রিয়জন হারানোর বিলাপ নেই। রয়েছে শুধুই কালীপুজোয় বাজি-বিলাস।