নিজস্ব প্রতিনিধি, দুর্গাপুর: দুর্গাপুরের শোভাপুরের বেসরকারি মেডিকেল কলেজ লাগোয়া পরাণগঞ্জ জঙ্গল। সেখানেই ঘটে ডাক্তারি পড়ুয়াকে গণধর্ষণের ঘটনা। জঙ্গলটি বনদপ্তরের নথিভুক্ত। ভূতের আতঙ্ক ছড়িয়ে সেটিকে মুক্তাঞ্চল বানিয়ে রেখেছিল দুষ্কৃতীরা। কৌশলে প্রচার করা হতো, সন্ধ্যা নামলেই জঙ্গলে অশরীরী আত্মারা ঘুরে বেড়ায়। শ্মশানেও রুদ্রমূর্তি নিয়ে বসবাস করেন শ্মশানকালী। তিনি খুব একটা সুবিধের নন। জঙ্গলের ভিতরের রাস্তায় রয়েছে ভৈরব স্থান। সেটিও ভয়ঙ্কর। সবমিলিয়ে একটা গা ছমছমে পরিবেশের বাতাবরণ তৈরি করে রেখেছিল দুষ্কৃতীরা। ফলে, একটু রাত হলেও আশপাশের লোকেরা জঙ্গলকে এড়িয়ে চলতেন। আর অবাধে নেশা-ভাঙ, অসামাজিক কার্যকলাপ চালিয়ে যেত দুষ্কৃতীরা। ডাক্তারি ছাত্রীকে গণধর্ষণে এই নির্জনতা ও ভয়াবহ পরিবেশকে পুরোদমে ব্যবহার করেছিল তারা।
রবিবার ভোর থেকেই জঙ্গল ঘিরে অভিযান চালাচ্ছিল পুলিশ। সেই সময় জঙ্গেলের পথ ধরে বাইক নিয়ে আসছিলেন এক স্থানীয় ব্যবসায়ী। পুলিশের জেরার মুখে পড়েন তিনি। ব্যবসায়ী জানান, দুর্গাপুরের উইলিয়াম কেরি মোড়ে তাঁর দোকান রয়েছে। বাড়ি পরানগঞ্জে। প্রতিদিন সকালে জঙ্গলপথ হয়ে দোকান খুলতে যান। বিকেল হতে না হতেই গ্রামে ফিরে আসেন। কারণ একটাই—আতঙ্ক। তিনি বলছিলেন, ‘রাস্তাতে ভৈরব স্থান রয়েছে। অশরীরী আত্মাদের উপদ্রব হয় বলে শুনেছি। তাই দোকান বন্ধ করে তাড়াতাড়ি চলে আসি। আসার পথে দেখি, জঙ্গলজুড়ে মদ-গাঁজার আসর। প্রাণহাতে নিয়ে কে যাবে এদিকে!’ ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই জঙ্গলপথে একটি বাইকে এলেন তিনজন যুবক। তাঁরা বলছিলেন, ‘কিছুটা দূরেই শ্মশান। সন্ধ্যার পর আমরা কেউই আসি না।’
দুর্গাপুরের ওই বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে মোহনবাগান সরণি দিয়ে বেরোলেই ঢিলছোঁড়া দূরে বাঁদিকে পড়বে পরাণগঞ্জ জঙ্গল। সরণি থেকে লাল মাটির একটি রাস্তা জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গিয়েছে। সেই রাস্তার দু’টি ভাগ। একদিকে পরাণগঞ্জ কালীমন্দির ও শ্মশান। অন্য রাস্তাটি চলে গিয়েছে পরাণগঞ্জ গ্রাম হয়ে জেমুয়া। বড্ডা সংকীর্ণ রাস্তা। অভিযোগ, শনিবার রাতে ওই সংকীর্ণ রাস্তার পাশেই ডাক্তারি পড়ুয়ার উপর নির্যাতন চালানো হয়। দিনের বেলায় রাস্তাটি দিয়ে স্থানীয় মানুষের যাতায়াত থাকলেও রাত হলে কেউই আসেন না। পার্শ্ববর্তী ইস্পাতপল্লি এলাকার এক ব্যবসায়ীর দাবি, জঙ্গলকে ঘিরে ভীতির পরিবেশ পরিকল্পনা করেই করা হয়েছে। যাতে ওই এলাকাকে নির্জন করে দেওয়া যায়। তা হলে নিশ্চিন্তে দুষ্কৃতীরা মদ-গাঁজার আসর বসাতে পারে। পুলিশও এ পথ মাড়ায় না। দুষ্কৃতীদের আরও একটি উদ্দেশ্য রয়েছে। তা হল এলাকার কেউ ভুল করে জঙ্গলে ঢুকে পড়লেই তাঁর সর্বস্ব লুট করা।
সদ্য মেডিকেল পড়ুয়াদের ভূতের ভয় বলে কিছু থাকে না। যুক্তি, বিজ্ঞানে বিশ্বাসী। অশরীরী আত্মা বলে যে কিছু নেই, সেটা তাঁরা বোঝেন। ফলে, প্রায় সকলেই সাহসী হন। নির্জনতা খোঁজেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজের প্রিয়জনের হাত ধরে বেরিয়ে পড়েন নির্জন এলাকায়। মোহনবাগান সারণি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তাঁরা চলে যান জঙ্গলের ভিতরে। শনিবার রাতেও তেমনি ঘটেছিল বলে পুলিশের দাবি। দুষ্কৃতীরা প্রথমে ছিনতাই, তারপর নির্যাতন চালায় বলে অভিযোগ।
প্রশ্ন উঠছে, দুর্গাপুরের মত আধুনিক শহরে জঙ্গল ঘিরে এমন আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হল কেন? পুলিশ-প্রশাসন বিষয়টি নিয়ে কেন তৎপর ছিল না। পুলিশের একাংশে সাফাই, মোহনবাগান সরণি ধরে গাড়ি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে টহল দেয়। তারা স্বীকার করে নিয়েছে, বাইক টহলের ব্যবস্থা না থাকায় জঙ্গলের ভেতরে কখনো টহল দেওয়া হয়নি। বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই বা কেন বাড়তি জঙ্গলে পড়ুয়াদের যাতায়াত নিয়ে সতর্ক হয়নি?