• বৃষ্টিতে ধস নেমে বন্ধ একমাত্র যাতায়াতের পথ, আপেলের পচনই কাশ্মীরের ‘কপাল’?
    এই সময় | ১৩ অক্টোবর ২০২৫
  • জাভেদ ইকবাল, শ্রীনগর

    দেশের বাকি অংশের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র জাতীয় সড়ক (এনএইচ ৪৪) বন্ধ বৃষ্টি, ভূমিধসে। তা–ও নয় নয় করে তিন সপ্তাহ। শ্রীনগর–জম্মু হাইওয়েতে দাঁড়িয়ে চার হাজারেরও বেশি আপেল–বোঝাই ট্রাক, সব মিলিয়ে ফসলের দাম কয়েক কোটি। সারা বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম যে ফলের জন্ম দিয়েছিল, সাম্প্রতিক বিপর্যয়ে সে সবই ধীরে ধীরে পচে যেতে দেখলেন উপত্যকার কৃষকরা।

    এখন রাস্তা খুলেছে, দিল্লি–সহ দেশের নানা বাজারে আপেল পৌঁছে দিতে বিশেষ ট্রেন পরিষেবাও শুরু হয়েছে, কিন্তু ক্ষতিও যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। জম্মু–কাশ্মীরের জিডিপির ৮ শতাংশ আসে আপেল থেকে। এর উপরে নির্ভরশীল কমপক্ষে ৩৫ লক্ষ মানুষ, কৃষকদের পাশাপাশি আছেন বহু ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ী, বিক্রেতাও। তবু তাঁদের বারবার এমন বিপর্যয়ে পড়তে হয়। প্রায় ফি বছরই ফসল তোলার মরশুমে মুষলধারে বৃষ্টি, ধস, বন্ধ রাস্তায় আটকে পড়া হাজার হাজার ট্রাকে পচে যায় আপেল। এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে অন্যতম বড় সঙ্কট অবশ্য তৈরি হয়েছে এ বার। ফসল পচে যাওয়ায় দাম কমেছে ৪০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত। ব্যবসায়ীদের হিসেবে, লোকসানের অঙ্ক প্রায় দু’হাজার কোটি। জম্মুর নাড়ওয়াল ফ্রুট মান্ডিতে যেখানে এক বাক্স ‘গিরাভ’ আপেল থেকে ৫০০ টাকা আয় হতো, সেটাই এ বছর কমে হয়েছে মাত্র ১০০ টাকা।

    কয়েক হাজার কৃষকের হাহাকার শোনা যাচ্ছে মুখ্যমন্ত্রী ওমর আব্দুল্লাহর গলাতেও। তাঁর কথায়, ‘ওই হাইওয়ের দেখভালের দায়িত্ব কেন্দ্রের। ওরা যদি রক্ষণাবেক্ষণ করতে না পারে, তা হলে জম্মু–কাশ্মীর সরকারকে দিয়ে দিক। আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা প্রস্তুত। এনাফ ইজ় এনাফ।’ কাশ্মীর ভ্যালি ফ্রুট গ্রোয়ার্স অ্যান্ড ডিলার্স ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আহমেদ বশির বলেন, ‘বাজারে যে ফল আসছে, তার অধিকাংশই পচে গিয়েছে। আমরা নিজেদের বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি বলি, অথচ একটা হাইওয়ের অংশ মেরামত করতে পারি না?’ তাঁর ক্ষোভই কার্যত গোটা উপত্যকায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। দাম তলানিতে ঠেকলেও কেউ কিনতে চাইছেন না, কারণ অধিকাংশ ফলই পচে খয়েরি হয়ে গিয়েছে।

    দেশের মোট আপেলের প্রায় ৭০ শতাংশ, ২০ লক্ষ মেট্রিক টনেরও বেশি, উৎপন্ন হয় কাশ্মীরে। বাণিজ্যের অঙ্ক প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। দেশের বড় শহরগুলির সঙ্গেই পশ্চিম এশিয়া এবং দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বাজারে যায় কাশ্মীরের আপেল।

    সেই ফসলকে পচনের হাত থেকে বাঁচাতে, দ্রুত অন্যত্র পৌঁছে দিতে জম্মু রেলওয়ে ডিভিশন সম্প্রতি কিছু ফ্রেট ওয়াগন চালু করেছে। প্রতিটি ওয়াগন ৪০ কেজির ৭৬টি কন্টেনার বহন করতে পারে। বিশেষ প্যানেল লাগিয়ে, কোল্ড স্টোরেজের ক্ষমতা বাড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ তাজা রাখার ক্ষমতাও রয়েছে সেগুলির। কিন্তু কাঠামোগত গভীর ক্ষতে এই উদ্যোগ সামান্য প্রলেপ। এতে মূল সমস্যার সমাধান হয়নি।

    ৪ হাজার ১১২ কিমি দীর্ঘ জাতীয় সড়ক এনএইচ ৪৪ শ্রীনগর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বিস্তৃত। এই একটি রাস্তাই কাশ্মীরের অর্থনৈতিক লাইফলাইন, যা আবার আবহাওয়ার উপরে পুরোপুরি নির্ভরশীল। ছবির মতো সাজানো, ঐতিহাসিক মুঘল রোড (জম্মুর পুঞ্চ ও কাশ্মীরের সোপিয়ানের সংযোগকারী রাস্তা) থাকলেও তা ভারী পণ্য বহনের যোগ্য নয়। কাজেই সেই রাস্তা দিয়ে এই বিপুল ফসল নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। এ দিকে, বর্ষাকালে নিয়মিত ধস নামে ওই জাতীয় সড়কে। অথচ কোনও সরকারই বিকল্প ব্যবস্থা করে উঠতে পারেনি। সরকারি স্তরে এক্সক্লুসিভ ফ্রেট করিডর, আধুনিক কোল্ড স্টোরেজ থেকে রেলপথ তৈরির আশ্বাস মিললেও বাস্তবায়ন ঘটেনি।

    কিন্তু কেন? কাশ্মীর তো ফুল–ফলের আঁতুড়ঘর। গত বছরের ইকোনমিক সার্ভে রিপোর্টই জানাচ্ছে, ২০২০–’২৪ পর্যন্ত সময়ে জম্মু–কাশ্মীরের ফলনশীল এলাকার আয়তন বেড়েছে ১০ হাজার হেক্টর। ২০২০–’২১ এর ২২.৩ লক্ষ মেট্রিক টন থেকে ২০২৩–’২৪ এ মোট উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ২৬.৪৩ লক্ষ মেট্রিক টন। তা সত্ত্বেও সরকারের উদ্যোগে গতি আসেনি। সোপিয়ানের ফলচাষী বাশারত আহমেদ ভাটের কথায়, ‘এ বারের বিপর্যয়ের শিক্ষা একটাই — বৃষ্টির আগে সরকারকে পদক্ষেপ করতে হবে। না হলে আগামী বছরও নিজেদের জীবন–জীবিকাকে পচতে দেখব আমরা।’

    আপেল চাষ কাশ্মীরের জন্য শুধুই অর্থনৈতিক বিষয় নয়, বাসিন্দাদের রক্তের সঙ্গে এর যোগ। তাই আটকে থাকা ট্রাকে শুধু ফলই নষ্ট হয় না, তার সঙ্গে মানুষের অর্থ–আশা ও সরকারের উপরে আস্থাতেও পচন ধরে। সরকার যদি শক্তিশালী হাইওয়ে, ঠিকঠাক কোল্ড স্টোরেজ ও রেল যোগাযোগের ব্যবস্থা না করে, তা হলে আবহাওয়ার মর্জি ও প্রশাসনিক অবজ্ঞার ‘ভরসাতেই’ বাঁচতে হবে কাশ্মীরি কৃষকদের।

  • Link to this news (এই সময়)