আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে সোমবার থেকেই বর্ষা বিদায় নিতে শুরু করেছে। অর্থাৎ, এ বছরের মতো ইতি! আসছে বছর আবার হবে। কিন্তু কলকাতা ও লাগোয়া এলাকার মানুষের স্মৃতিতে দগদগে হয়ে থেকে যাবে দেবীপক্ষের বৃষ্টি।
গত ২২ সেপ্টেম্বর রাত থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর ভোর পর্যন্ত যে অঝোর বর্ষণ কলকাতায় হয়েছিল, তাকে সংজ্ঞা মেনে আবহাওয়াবিদেরা বলেছেন, আর কয়েক মিলিমিটার বৃষ্টি হলেই বলা যেত ‘মেঘভাঙা বৃষ্টি’। যেমন সাধারতণ হয় হিমাচলপ্রদেশ বা উত্তরাখণ্ডে। সংজ্ঞা যা-ই হোক, কলকাতা টের পেয়েছে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়া কাকে বলে। যার রেশ থেকেছে কোথাও ৪৮ ঘণ্টা আবার কোথাও কোথাও ৭২ ঘণ্টা বা তারও বেশি। সেই তুমুল বৃষ্টিদিনে প্রাণ গিয়েছে ১২ জনের। জলে ডুবে গিয়েছে হাজার হাজার গাড়ি। যা এখনও মেরামতির পরে রাস্তায় নামতে পারেনি।
আবার এমন বৃষ্টি হলে কি এমনই পরিস্থিতি তৈরি হবে কলকাতা এবং বৃহত্তর কলকাতায়? আগে থেকে পরিকল্পনা করে কি অবস্থা সামাল দেওয়া যাবে? সেই পরিকাঠামো কি আছে কলকাতা পুরসভার?
কলকাতা পুর প্রশাসন ও রাজ্যের সেচ দফতরের গুরুত্বপূর্ণ আমলাদের একটি অংশ একান্ত আলোচনায় মেনে নিচ্ছেন যে, আচমকা এমন বৃষ্টি ফের হলে তা সামাল দেওয়ার মতো পরিকাঠামো নেই কলকাতা শহরে। অতীতে বর্ষার মরসুমের জন্য চার-পাঁচ মাস আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হত। নিকাশি ব্যবস্থা, পাম্প করে জমা জল শহর থেকে বার করে খালে ফেলার বন্দোবস্ত ইত্যাদি ছিল সেই পরিকল্পনার অংশ। কিন্তু প্রশাসনিক কর্তাদের মতে, সেই পরিকল্পনা করে এই বৃষ্টিতে কোনও লাভ হত না। তাঁদের মতে, দেবীপক্ষের ওই বৃষ্টি ছিল ‘ব্যতিক্রম’।
প্রায় পাঁচ দশক পর এমন বৃষ্টি হল শহরে। কলকাতা পুরসভার এক পদস্থ আমলার কথায়, ‘‘যা ৫০ বছরে এক বার হয়, তাকে আমরা ব্যতিক্রম হিসাবেই ধরব। এক মাসের বৃষ্টি কয়েক ঘণ্টায় হলে তা সামলানো সত্যিই মুশকিল।’’ সেচ দফতরের এক গুরুত্বপূর্ণ আমলারও বক্তব্য, ‘‘সেপ্টেম্বরের ওই বৃষ্টিকে স্বাভাবিক হিসাবে ধরলে হবে না। ওই রকম বৃষ্টি হলে কারওরই কিছু করার নেই।’’ একই কথা বলছেন প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের আমলে পুর-প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় কাজ করা এক পদস্থ আধিকারিকও। তাঁর কথায়, ‘‘সারা রাত ধরে ওই বিপুল পরিমাণ বৃষ্টিপাত আমি নিজে বাড়িতে জেগে থেকে দেখেছি। তখনই মনে হয়েছিল, পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গিয়েছে। ওই বৃষ্টি সামাল দেওয়ার মতো পরিকাঠামো এই শহরে এখনও পর্যন্ত নেই। সকালে বৃষ্টি না ধরলে যে কী হত, তা আমাদের কল্পনারও বাইরে।’’
অর্থাৎ, আবার যদি ওইরকম আকাশভাঙা বৃষ্টি হয়, তা হলে তা সামাল দেওয়ার মতো পরিকাঠামো পুর-প্রশাসনের কাছে নেই। অন্তত এখনও পর্যন্ত।
জলবন্দি কলকাতায় স্বাভাবিক ভাবেই পুরসভার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন থেকে বাদ যায়নি রাজ্য সেচ দফতরের ভূমিকাও। কারণ, কলকাতার জমা জল যে যে খালে গিয়ে পড়ে, তার সবগুলিই সেচ দফতরের এক্তিয়ারভুক্ত। অতীতে সুব্রত মুখোপাধ্যায় বা শোভন চট্টোপাধ্যায় যখন কলকাতার মেয়র ছিলেন, সেই পর্বে বর্ষা আসার অন্তত চার মাস আগে থেকে নিকাশি সংক্রান্ত প্রস্তুতি শুরু হত। সাম্প্রতিক সময়ে তাতে ভাটা পড়েছে বলেই বক্তব্য। প্রশাসনেরও অনেকে মেনে নিচ্ছেন যে, পরিস্থিতি বদলাতে প্রাথমিক ভাবে পুরসভা এবং সেচ দফতরের সমন্বয় আরও বাড়ানো প্রয়োজন। যেমন প্রয়োজন খরচের বিষয়ে নির্দিষ্ট পরিকল্পনার করারও। কিন্তু সেই সমস্ত পদক্ষেপ করার পাশাপাশিই তাঁরা আরও একটি ‘বিধিসম্মত সতর্কীকরণ’ও দিয়ে রাখছেন—সমন্বয় নিবিড় হলেও সেপ্টেম্বরের মতো ব্যতিক্রমী বৃষ্টি হলে কিছু করার থাকবে না।
কলকাতা শহরে বিভিন্ন খালের রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত গত বছর একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, সার্কুলার খালের ১৪ শতাংশে রক্ষণাবেক্ষণ হয়। বাগজোলা খালের রক্ষণাবেক্ষণ হয় ২৫ শতাংশে। আদিগঙ্গার ৩৭.৫ শতাংশে। গবেষণা অনুযায়ী খাল অবরুদ্ধ হয়ে থাকা, জলে দূষণের মাত্রার পরিসংখ্যান আরও ভয়াবহ। সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া অবশ্য খাল সংস্কারের ব্যাপারে ভিন্ন দাবি করেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘২০২১ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বেশ কিছু খালের সংস্কার হয়েছে। এখনও কিছু খালের সংস্কার ও পরিষ্কার চলছে। পুরসভাগুলির সঙ্গে সমন্বয় করেই সেচ দফতর আগামীর রূপরেখা তৈরির কাজ করবে।’’
কলকাতার নিকাশি ব্যবস্থার সঙ্গে পুরোদস্তুর জুড়ে রয়েছে সেচ দফতরের অধীনস্থ খালগুলি। প্রশাসনের সঙ্গে যুকত্ সকলেই জানেন যে, পাম্পিং স্টেশনের ক্ষমতা বাড়িয়ে শহরের জল দ্রুত নামানোর বন্দোবস্ত করলেও খাল সংস্কার না-হলে কোনও কাজের কাজ হবে না। নাব্যতা কমে-যাওয়া, জঞ্জালে অবরুদ্ধ খাল বাড়তি জল বহন করতে পারবে না।
অর্থাৎ, খালের হাল ফেরাতে হবে। কিন্তু বাস্তব চিত্র কী?
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেল, পূ্র্ব কলকাতার নাজিরাবাদের বিস্তীর্ণ এলাকায় খালের গর্ভে ঢুকে গিয়েছে দোকানের কাঠামো। চৌবাগার জায়গায় জায়গায় খালের মধ্যে নেমে গিয়েছে বাতিল প্লাস্টিকের জিনিসপত্রের মালগুদাম। বাসন্তী হাইওয়ে সংলগ্ন জনপদে এক কথায় যথেচ্ছাচার হচ্ছে! চকচকে তারকাখচিত বহুতল আবাসনের ঠিক পাশেই পরিকল্পনাহীনতার বিজ্ঞাপন। সেচ দফতরের আধিকারিকেরা তাঁদের বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে বলছেন, কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকার খাল সংস্কার করতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, খাল থেকে উঠছে আস্ত বিছানা। উঠে আসছে মৃত গরু বা ভেড়ার দেহ। তাঁরা এর দায়ভার চাপিয়েছেন মানুষের সচেতনতার উপর। কিন্তু মানুষকে ‘সচেতন’ করতে যে কঠোর ‘প্রশাসনিক দাওয়াই’ প্রয়োজন, তা নিয়ে বিশেষ কেউ উচ্চবাচ্য করছেন না। কলকাতা পুরসভার এক কর্তা যেমন বলছেন, ‘‘প্লাস্টিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অনেক সময়ে পরিকল্পনা হয়েছে। কিন্তু তা বাস্তবয়ানের ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে। যা নিকাশি অবরুদ্ধ হওয়ার বড় কারণ।’’
এ কথা ঠিক যে, গঠনগত দিক থেকে কলকাতার ‘প্রতিবন্ধকতা’ রয়েছে। গঙ্গা কলকাতার পশ্চিমে। কিন্তু কলকাতার ঢাল পুবদিকে। বৃষ্টি বা অতিবৃষ্টিতে কলকাতায় জল জমলে একটা কথা বারবার আলোচিত হয় যে, কলকাতার আকৃতি গামলার মতো। ফলে জল জমে থাকার প্রবণতাই বেশি। তার উপরে এক মাসের বৃষ্টি চার-পাঁচ ঘণ্টায় হয়ে গেলে পরিস্থিতি যে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই পুর-প্রশাসনের আধিকারিকদের। চটজলদি যে কিছু করা যাবে, তা-ও নয়। অগত্যা দেবীপক্ষের আকাশভাঙা বৃষ্টিকে ‘ব্যতিক্রম’ ভেবেই আপাতত স্বস্তিতে প্রশাসন।