অসিত রজক, বাঁকুড়া: বাঁকুড়ায় দলমার দলের আস্তানা। দিনে জঙ্গলে রাতে লোকালয়ে এই লুকোচুরিতে নষ্ট খেত, ভাঙচুর বাড়ি। অভিযানে নেমে ঘাম ছুটছে বনকর্মীদের, রোষের মুখে পড়ে অষ্টপ্রহর নাম জপছেন বনকর্মীরাও।
মাঠে পাকছে ধান। তার টানেই পুজোর আগেই দলমার দাঁতাল দল বেঁধে পশ্চিম মেদিনীপুরের সীমানা পেরিয়ে চলে এসেছে বাঁকুড়ায়। তবে শুধু বাঁকুড়া উত্তর বনবিভাগে নয়, দক্ষিণ বাঁকুড়ার জঙ্গলেও হাতির দল আস্তানা গেড়েছে। আর হাতির দলের উপস্থিতিতে ঘুম ছুটেছে বাঁকুড়ার জঙ্গল লাগোয়া গ্রামের বাসিন্দা ও চাষিদের। হাতিদের তাড়ানোর দাবি তুলে সরব হচ্ছেন জঙ্গল লাগোয়া গ্রামের বাসিন্দারা। আর হাতি তাড়াতে গিয়ে বাসিন্দাদের রোষের মুখে পড়েছেন বনকর্মীরা। সম্প্রতি সোনামুখী ও পাত্রসায়ের রেঞ্জের জঙ্গলে থাকা হাতিদের তাড়ানোর অভিযানে গিয়ে মার খেয়েছেন বনকর্মীরা। এর ফলে আতঙ্কে এবার বনকর্মীরাও।
বনদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর পুজোর আগেই দলমার একটা দল পশ্চিম মেদিনীপুরের সীমানা পেরিয়ে বিষ্ণুপুর পাঞ্চেত বনবিভাগের জঙ্গলে ঢুকে পড়ে। এরপর সেখানে কিছুদিন কাটানোর পরেই তাঁরা বাঁকুড়া উত্তর বনবিভাগের জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। হাতির এক একটা দলে কখনও ৩০-৩৫টি হাতি থাকে। আবার কোথাও ৪০—৫০টি হাতি। কোথাও আবার ৬০-৮০টি হাতির দল ঢুকে পড়ে। বিষ্ণুপুর, জয়পুর থেকে রাধানগর, পাত্রসায়ের হয়ে সোনামুখীর জঙ্গলে তারা আস্তানা গাড়ে। তবে এখানেই সমাপ্তি নয়। সোনামুখী থেকে হাতির দল আরও উত্তর-পশ্চিমমুখী হয়ে বেলিয়াতোড়, বড়জোড়া, গঙ্গাজলঘাটি, মেজিয়া হয়ে একেবারে বাঁকুড়া উত্তর রেঞ্জের জঙ্গলেও আস্তানা গাড়ে। আর এই যাতায়াতের পথে কার্যত জঙ্গল লাগোয়া জমির ধান খেয়ে, মাড়িয়ে তছনছ করে দিয়ে যায় হাতিরা।
এর পাশাপাশি জঙ্গল ছেড়ে লাগোয়া গ্রামগুলিতেও রাতের অন্ধকারে হানা দেয় তারা। জমির ফসল নষ্টের পাশাপাশি প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে বারবার। তাই জঙ্গল সংলগ্ন গ্রামবাসীদের ও বনকর্মীদের রাতের ঘুম উড়ছে। তাই হাতির দলকে জঙ্গলে তাড়ানোর জন্য প্রায়দিনই হুলাপার্টিকে সঙ্গে নিয়ে অভিযান চালান বনকর্মীরা। অভিযানে গিয়ে বনকর্মীদের মার খেতে হয়েছে বলে অভিযোগ। ফলে বনকর্মীদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়েছে। ২৬ সেপ্টেম্বর পাত্রসায়েরর বনবীরসিংহ পঞ্চায়েতের বর্গা এলাকায় হাতি খেদাতে গিয়ে সোনামুখী রেঞ্জের কর্মী ইদ্রিশ সরকার, বাপন রায় ও মহিবুল মণ্ডলকে বেধড়ক মারধর করা হয়। এরপর ৮ অক্টোবর সোনামুখী থানার ধানশিমলা পঞ্চায়েতের বাঁশখুলা এলাকায় বাঁকুড়া ওয়াইল্ড লাইফ স্কোয়াডের সদস্য সহদেব লোহারকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এই দু’টি ঘটনায় ঘটেছে হাতি তাড়ানোর সময়ে। এই ঘটনায় হাতি তাড়াতে যাওয়া বনকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। সোনামুখীর রেঞ্জ আধিকারিক নিলয় রায় বলেন, “হাতির দল বারবার রুট বদল করে। জঙ্গলপথে চলতে গিয়ে আচমকা পাশের লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। যাতে কোনও অঘটন না ঘটে এজন্য আমরা নজরদারির পাশাপাশি হাতিদের অন্যত্র সরানোর চেষ্টা করছি। আর এই কাজ করতে গিয়ে বনকর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছেন। গত দুই সপ্তাহের মধ্যে পাত্রসায়ের ও সোনামুখী রেঞ্জের জঙ্গলে বনকর্মীরা আক্রান্ত হয়েছেন। ফলে হাতি তাড়ানো অভিযান বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। বনকর্মীদের উপরে যাতে কোনও হামলা না হয় সেজন্য স্থানীয়দের সচেতন থাকতে হবে। কারণ, হাতিদের তাড়ানোর কাজ আমরা করলেও হাতির দল মর্জিমাফিক ঘোরাফেরা করে। আর এত বিপুল সংখ্যক হাতির দলকে সামলাতে হিমশিম খেতে হয় বনকর্মীদের। এর মধ্যে বনকর্মীরা কাজ করতে গিয়ে মার খেলে তো সমস্যা আরও বাড়বে।”
উল্লেখ্য, সোনামুখী ও পাত্রসায়ের রেঞ্জের মরাচৈতা, ময়রাপুকুর, বনবীরসিংহের জঙ্গলে শাবক-সহ ৭টি হাতি ঘোরফেরা করছে। অন্যদিকে, গোয়ালতোড়ের জঙ্গল থেকেও শাবক-সহ ৩০টি হাতির দল দক্ষিণ বাঁকুড়ার সারেঙ্গার কাড়ভাঙ্গা, বড় গাড়রা, কয়মার জঙ্গলে আস্তানা গেড়েছে। বাঁকুড়ার ডিএফও (দক্ষিণ) প্রদীপ বাউরি বলেন, “প্রায় ৩০টি হাতির একটি দল গোয়ালতোড় ও সারেঙ্গার সীমানা এলাকায় ঘোরাফেরা করছে। বনকর্মীদের নজর রাখতে বলা হয়েছে। হাতির দল যাতে ক্ষয়ক্ষতি করতে না পারে এজন্য হুলাপার্টির সাহায্যে পাহারা চালানো হচ্ছে।”