• কমেছে মাটির প্রদীপের চাহিদা, কালীপুজোর আগে ম্লান হাওড়ার কপূর গলি
    আনন্দবাজার | ১৫ অক্টোবর ২০২৫
  • যে গলিতে তৈরি মাটির প্রদীপ এক সময়ে বাংলা, বিহার, ওড়িশায় আলো ছড়াত, হাওড়ার গোলাবাড়ির সেই কপূর গলিতে এখন ঘোর অন্ধকার। মাটির প্রদীপের ব্যবহার কমতে কমতে প্রায় তলানিতে পৌঁছে যাওয়ায় কপূর গলির সার সার টালি ও টিনের চালের বাড়িগুলিতেও নেমে এসেছে অভাব-অনটনের অমাবস্যা। এক সময়ে কালীপুজো বা দীপাবলির আগে এখানকার ঘরে ঘরে তৈরি হওয়া মাটির প্রদীপ কিনতে ক্রেতাদের ভিড় লেগেই থাকত। বর্তমানে বেশি বিক্রি হচ্ছে বৈদ্যুতিক আলো লাগানো প্লাস্টিকের তৈরি প্রদীপ। যার জেরে সঙ্কটে পড়েছে বাংলার এই কুটির শিল্প। তবু এখনও দীপাবলির আগে মাটির প্রদীপ তৈরি করে বিক্রির অপেক্ষায় থাকে অবাঙালি পরিবারগুলি। যারা স্বাধীনতারও আগে থেকে বংশ পরম্পরায় বাস করছে ওই গলিতে।

    হাওড়ার গোলাবাড়ি এলাকায়, ঘন বসতিপূর্ণ ঘিঞ্জি পাড়ার মধ্যেই রয়েছে এই কপূর গলি। যে গলিতে বর্ষায় হাঁটুজল জমে যায়। অভিযোগ, হাওড়া পুরসভা নিয়মিত আবর্জনা সাফাই না করায় প্রায়ই যত্রতত্র জঞ্জাল জমে থাকে। এমনই অবহেলিত একটি গলিতে বসবাস করে বহু দশক আগে বিহার থেকে আসা ১০-১৫টি পরিবার। তাদের পেশা, মাটির ভাঁড় এবং প্রদীপ তৈরি করা। এক সময়ে পরিবারের সব সদস্যই মাটির জিনিসপত্র বানাতেন।

    ঘরের দাওয়ায় ছাঁচ থেকে মাটির প্রদীপ বার করতে করতে এমনই এক পরিবারের প্রবীণ সদস্য, বছর আটষট্টির ছেটু প্রজাপতি জানান, এক সময়ে ভোর থেকে উঠে রাত ১০টা পর্যন্ত পরিবারের ছোট, বড় সকলে মিলে এই কাজ করতেন। কালীপুজোর সময়ে প্রদীপ ও ভাঁড়ের চাহিদা এতটাই বেড়ে যেত যে, তা সরবরাহ করতে সকলকে হিমশিম খেতে হত। ওই চাহিদার জন্যই তখন তাঁদের সংসারে অভাব বলতে কিছু ছিল না।

    ছেটু বলেন, ‘‘চিনের প্রদীপ আসার পরেই আমাদের বিক্রি কমতে শুরু করে। আমাদের অ্যাসোসিয়েশন থেকে রাজ্য সরকারের কাছে বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে বাঁচানোর জন্য বহু চিঠি লেখা হয়েছে। কিন্তু কোনও ফল হয়নি। এখন আমাদের ডায়মন্ড হারবার থেকে মাটি আনতে গেলেও পুলিশ ও নেতাদের টাকা দিতে হয়। পুঁজি ও কাঁচামালের অভাবে ব্যবসাটাই বন্ধ হতে বসেছে।’’ কথা বলতে বলতে চোখের কোণে জল চিকচিক করে ওঠে ওই প্রবীণ ব্যক্তির। সামলে নিয়ে বলেন, ‘‘এখন এমনই অবস্থা যে, বয়স্কেরা ছাড়া কেউ আর এই প্রদীপ, ভাঁড় বানাতে চায় না। ছোটরা এখন অন্য কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে। খেয়ে-পরে বাঁচতে হবে তো?’’

    মিষ্টির দোকানগুলিও মাটির ভাঁড়ের ব্যবহার কমিয়ে দেওয়ায় সমস্যায় পড়ছে পরিবারগুলি। কুলদীপ প্রজাপতি নামে আর এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘মাটির বদলে লোকজন এখন প্লাস্টিকের প্রদীপ, কাগজের পাত্রের দিকে ঝুঁকেছে। আমরা কয়েকটি পরিবার কিন্তু এখনও মাটির ভাঁড় ও প্রদীপ বানিয়ে চলেছি। রাজ্য সরকার যদি একটু পাশে দাঁড়ায়, তা হলে আমরা এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে পারব।’’

    সরকার যখন প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোর জন্য পরিবেশবান্ধব জিনিসের উপরে জোর দিচ্ছে, পরিবেশবিদেরা প্লাস্টিকের বিপদ সম্পর্কে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন, তখন মাটির ভাঁড় বা প্রদীপ শিল্পীদের বাঁচাতে হাওড়া জেলা প্রশাসন কেন এগিয়ে আসছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কপূরগলির ওই পরিবারগুলি।

    হাওড়া জেলা প্রশাসনের এক পদস্থ কর্তা বলেন, ‘‘জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গ্রামীণ শিল্প নিয়ে একাধিক মেলা হয়। কুটির শিল্প নিয়েও নানা অনুষ্ঠান হয়। রাজ্য সরকার কুটির শিল্প বাঁচাতে বদ্ধপরিকর। খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেব।’’
  • Link to this news (আনন্দবাজার)