আজকাল ওয়েবডেস্ক: এ বছরের দুর্গাপুজোয় পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি ছুঁয়েছে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকার মাইলফলক। অর্থনীতিবিদ অজিতাভ রায়চৌধুরীর মতে, গত বছরের তুলনায় পুজোয় ব্যবসার পরিমাণমূল্যে বৃদ্ধি হয়েছে কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ শতাংশ। যদিও টানা বৃষ্টিপাত এবং আসন্ন GST 2.0 চালুর আগে কেনাকাটায় সাময়িক বিরতি বাজারে কিছুটা ধাক্কা দিয়েছে, তবুও সামগ্রিকভাবে উৎসবের অর্থনীতি আশানুরূপ ফল দিয়েছে।
২০১৯ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিলের এক সমীক্ষা কলকাতার দুর্গাপুজো অর্থনীতিকে হিসেব করেছিল প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা। গত বছর সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫ থেকে ৫৭ হাজার কোটিতে। শিল্পমহলের অনুমান ছিল, এই বছর তা ৭০ হাজার কোটি ছাড়িয়ে যাবে। যদিও প্রবল বৃষ্টি এবং করব্যবস্থার অনিশ্চয়তায় কিছুটা ঘাটতি হয়েছে, তবু কলকাতার অবদানই মোট ব্যবসার ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ।
কলকাতার প্রায় ২,৫০০টি দুর্গাপুজো কমিটি মিলিয়ে এ বছরই মূর্তি, আলোকসজ্জা, সাজসজ্জা ও আনুষ্ঠানিকতায় খরচ করেছে আনুমানিক ২০০ কোটি টাকা। রাজ্যজুড়ে সেই খরচের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা। এই বিপুল ব্যয়েই কয়েক মাসের জীবিকা টিকে থাকে অসংখ্য শিল্পী, কারিগর, আলোকশিল্পী ও ছোট ব্যবসায়ীর।
সবচেয়ে বেশি লাভের মুখ দেখেছে খাদ্য ও পানীয় (F&B) খাত। রেস্তরাঁগুলিতে দর্শনার্থীর সংখ্যা বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। হোটেল ও রেস্তরাঁ মালিকদের সংগঠন HRAEI-এর সভাপতি সুশীল পোদ্দার জানিয়েছেন, শুধু রেস্তরাঁখাত থেকেই আয় হয়েছে প্রায় ১,২০০ থেকে ১,৫০০ কোটি টাকা, যার ৬০ শতাংশই কলকাতা থেকে। রেস্তরাঁ উদ্যোক্তা অঞ্জন চট্টার্জি ও সিদ্ধার্থ কোঠারি জানিয়েছেন, পুরো পুজো জুড়ে তাঁদের রেস্তরাঁয় ছিল নজিরবিহীন ভিড় ও বিক্রি।
কলকাতার আটটি বড় শপিং মল মিলিয়ে এ বছর ব্যবসা হয়েছে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার, যা গত বছরের তুলনায় ৮ থেকে ১০ শতাংশ বেশি। অ্যাম্বুজা নেউটিয়ার সিটি সেন্টার মলগুলির তরফে রমেশ পাণ্ডে জানান, সেপ্টেম্বরের শেষ দিকের চাহিদা বৃদ্ধি ব্যবসাকে ভালো অবস্থানে রেখেছে। আকরোপোলিস মলে গত বছরের তুলনায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেশি দর্শনার্থী এসেছে। মেরলিন গ্রুপের কর্পোরেট জেনারেল ম্যানেজার শুভদীপ বসুর মতে, আগামী বছর আরও বেশি বিক্রি ও ভিড়ের আশা করা হচ্ছে। সাউথ সিটি মলের নির্বাহী পরিচালক অমিত কুমার জানান, চলতি পুজোয় তাঁদের মলে ফুটফল ও বিক্রি দুটোই রেকর্ড ছুঁয়েছে।
তবে ঐতিহ্যবাহী বাজারের চিত্র ততটা উজ্জ্বল নয়। গড়িয়াহাট, হাতিবাগান, নিউ মার্কেটের মতো পুরনো কেনাকাটার কেন্দ্রগুলোয় বিক্রি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গ ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের কনফেডারেশনের হিসাবে, এই বাজারগুলিতে মোট কেনাবেচা হয়েছে আনুমানিক ৮০০ কোটি টাকার। সংস্থার সভাপতি সুশীল পোদ্দার জানান, সেপ্টেম্বরের শুরুতে অনেক ক্রেতা নতুন GST সুবিধার জন্য অপেক্ষা করছিলেন, ফলে প্রাথমিকভাবে বাজারে একধরনের স্থবিরতা তৈরি হয়েছিল।
বঙ্গীয় চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সদস্য বিবেক জালান বলেন, “অনেক ক্ষেত্রে দুর্গাপুজোর এক মাসের বিক্রিই বার্ষিক বিক্রির প্রায় ২৫ শতাংশের সমান।”
সব মিলিয়ে, টানা বৃষ্টি ও করসংক্রান্ত আশঙ্কা সত্ত্বেও পুজোর উচ্ছ্বাসে এ বছরও রাজ্যের অর্থনীতিতে ছড়িয়ে পড়েছে প্রাণচাঞ্চল্য। কলকাতা কেন্দ্রিক এই উৎসব শুধু ধর্মীয় নয়, বরং এক বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়েছে— যেখানে শিল্পী, ব্যবসায়ী, রেস্তরাঁমালিক থেকে সাধারণ ক্রেতা— সকলে মিলে গড়ে তুলেছেন উৎসবের রঙিন অর্থনীতি।