• দেবী চৌধুরাণীর কালীমন্দিরে মায়ের হাতে সুরাপাত্র, ভোগে শোল-বোয়াল
    বর্তমান | ১৬ অক্টোবর ২০২৫
  • ব্রতীন দাস, জলপাইগুড়ি; জঙ্গলে ঘেরা চারদিক। পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে রুকরুকা নদী। রয়েছে শ্মশান। তারই মাঝে দেবী চৌধুরাণীর কালীমন্দির। সন্ধ্যা নামতেই নিঝুম হয়ে যায় চারদিক। মন্দির ঘিরে দিনের বেলাতেও গা ছমছমে পরিবেশ। আর পাঁচটা মন্দিরের চেয়ে এখানকার বিগ্রহ আলাদা। এখানে মা কালীর হাতে কোনও অস্ত্র নেই। দেবীর এক হাতে নরমুণ্ড, অন্য হাতে সুরাপাত্র। জলপাইগুড়ি গোশালা মোড়ের কাছে এই মন্দিরে শোল ও বোয়াল মাছ ছাড়া মায়ের ভোগ হয় না। বলির পাঁঠার মাংসও দেওয়া হয় ভোগে। 

    জনশ্রুতি, মন্দিরের পাশ থেকে বয়ে যাওয়া রুকরুকা নদী দিয়ে বজরায় চেপে আসতেন দেবী চৌধুরাণী। তাঁর হাতেই পুজো শুরু হয় এখানে। আগে বটগাছের নীচে মায়ের পুজো হতো। সেসময় বিশালাক্ষী রূপে দেবীর পুজো করতেন ডেঙ্গুয়াঝাড় চা বাগান এলাকার আদিবাসীরা। এরপর বেশ কিছুদিন এখানে পুজোর দায়িত্ব নেয় জলপাইগুড়ির রাজ পরিবার। কিন্তু জঙ্গলের মাঝে মায়ের পুজো খুব বেশিদিন চালাতে পারেনি তারা। রাজ পরিবার হাতগুটিয়ে নিলে এলাকার বাসিন্দারা নিজেদের কাঁধে তুলে নেন পুজোর দায়িত্ব। পরে তৈরি হয় পাকা মন্দির। বর্তমান মন্দিরে যেখানে বিগ্রহের বেদী, সেখানে নাকি একসময় বিশাল এক কপিকল ছিল। সেটি ঘোরালেই খুলে যেত গুহার দরজা। সুড়ঙ্গপথে এখান থেকে পৌঁছে যাওয়া যেত জলপাইগুড়ির পান্ডাপাড়ায়। 

    স্থানীয়দের দাবি, রুকরুকা নদীতে যে বজরা চলাচল করত, কয়েক দশক আগেও তার প্রমাণ ছিল। মন্দির চত্বরে যে বটগাছ রয়েছে, ইংল্যান্ডের এক উদ্ভিদ বিজ্ঞানীকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে জানা গিয়েছে সেটির বয়স চারশো বছরেরও বেশি। এমনটাই দাবি মন্দির কমিটির। ফলে ওই প্রাচীন বটগাছ সহ মন্দিরকে হেরিটেজ স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে আবেদন জানিয়েছে তাঁরা। 

    দেবী চৌধুরাণীর নামাঙ্কিত এই মন্দিরে একসময় নয়ন নামে এক কাপালিক থাকতেন। পাতু দাস নামে একজনকে বলি দিয়েছিলেন তিনি। এই অপরাধে ১৮৯০ সালে ফাঁসি হয় তাঁর। জলপাইগুড়ি জেলে লিপিবদ্ধ আছে সেই ইতিহাস। মন্দির চত্বরে রয়েছে পঞ্চমুন্ডীর আসন। কৌশিকী অমাবস্যার রাতে সাধনার জন্য আসেন তান্ত্রিকরা। ফি বছরের মতো এবারও মন্দিরে জোরকদমে চলছে কালীপুজোর প্রস্তুতি। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা তো বটেই, অসম থেকেও ভক্ত-দর্শনার্থীদের অনেকে এই মন্দিরে পুজো দিতে আসেন।    

    মন্দির কমিটির সম্পাদক দেবাশিস সরকার বলেন, এই মন্দিরের সঙ্গে দেবী চৌধুরাণীর প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে। বজরায় চেপে এই নদীপথে যাতায়াত ছিল দেবী চৌধুরাণীর। তখন জঙ্গলে ভরা ছিল চারদিক। শ্বাপদসঙ্কুল। তারই মাঝে বটগাছের নীচে মা কালীর পুজো করেন দেবী চৌধুরাণী।

    মন্দিরের পুরোহিত সুভাষ চৌধুরী বলেন, বেশিরভাগ জায়গাতেই কালীপুজোর রাতে দক্ষিণাকালীর পুজো হয়ে থাকে। কিন্তু এখানে মা শ্মশানকালী। সেজন্য তাঁর এক হাতে নরমুণ্ড, অন্য হাতে সুরাপাত্র। এখানে মায়ের আমিষ ভোগ হয়। ভোগে নানা ধরনের মাছ থাকে। এর মধ্যে শোল ও বোয়াল মাছ থাকবেই। মন্দির কমিটির পক্ষ থেকে পুজোর রাতে বলি দেওয়া হয় একটি পাঁঠা। এছাড়া মানতের পাঁঠা বলি হয়। বলির মাংসও ভোগ দেওয়া হয়। বিগ্রহের এক হাতে যে পাত্র রয়েছে, পুজোর সময় তাতে দেওয়া হয় সুরা। আগে মাটির মূর্তিতে পুজো হলেও ১৯৯৭ সালে রাজস্থানের জয়পুর থেকে কষ্টিপাথরের মূর্তি এনে প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেই থেকে ওই মূর্তিতে পুজো হচ্ছে। -নিজস্ব চিত্র 
  • Link to this news (বর্তমান)