দীপন ঘোষাল, রানাঘাট: চৈতন্য মহাপ্রভুর গৃহশিক্ষক ছিলেন কাশীনাথ সার্বভৌম। নবদ্বীপ-শান্তিপুরে তৎকালীন প্রথমসারির পণ্ডিত, শাস্ত্রজ্ঞদের মধ্যেই কাশীনাথ ছিলেন একজন। ছোট্ট নিমাই তাঁর টোলে পড়তে যেতেন। আবার কখনও কাশীনাথ নিজেই জগন্নাথ মিশ্রের বাড়িতে আসতেন বলে কথিত। পরে শিষ্য হয়ে ওঠেন বাংলার বৈষ্ণবধর্মের মহান প্রচারক ও ষোড়শ শতাব্দীর বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক। অন্যাদিকে, গুরু কাশীনাথ লালন করতে থাকেন শাক্তধর্মের। হয়ে ওঠেন মা কালীর পরম সাধক। তাঁরই সূচনা করা সেই কালীপুজো আজও নদীয়ার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী পুজোর মধ্যে একটি। যা শান্তিপুরের ‘চাঁদুনি মায়ের পুজো’ নামে খ্যাত। চৈতন্যযুগ থেকে চলে আসা কাশীনাথের কালীপুজো আজও সমান জাঁকজমকপূর্ণ। দেবীর মূর্তির নিরাপত্তায় থাকে সশস্ত্র পুলিশবাহিনী।
কথিত, তখন চাঁদুনি মায়ের পুজোর পাশ দিয়েই বয়ে যেত স্রোতস্বিনী গঙ্গা। সময়ের সঙ্গে ভূপ্রকৃতির পরিবর্তন হয়। নদী সরে যায় পশ্চিমে। পারিবারিক ইতিহাস বলছে, বালক কাশীনাথ একদিন মায়ের কাছে কালী মায়ের মূর্তি গড়ে দেওয়ার আবদার করে। সেই কালীর পুজো করতে চান। ছেলের অনুরোধ ফেলতে পারেননি মা। তিনি একটি মাটির মূর্তি গড়ে দেন। সেই মূর্তিতেই পুজো শুরু করে বালক কাশীনাথ। আজও সেই প্রথা মেনে মূর্তি তৈরি হয় কাশীনাথের উত্তরসূরির পরিবারে। কালীপুজোয় মহিলাদের ভূমিকা থাকে অগ্রগণ্য। প্রতিমা তৈরির প্রথম মাটির প্রলেপ পড়ে পরিবারের বয়োঃজৈষ্ঠা ও সম্মানীয় গৃহবধূর হাতে। দেবী দুর্গার বিসর্জনের দিনই চাঁদুনি মায়ের পাট স্থানান্তরিত হয় নিজস্ব মন্দিরে। অর্থাৎ, একই গৃহে দুর্গা ও কালীর আরাধনা। প্রতি মাসের আমাবস্যাতেও এই গৃহে পাট পুজো হয়। প্রাচীন নিয়ম মেনে আলপনা আঁকার চল রয়েছে। সেটা একেবারে মৌলিক। কালীপুজোর প্রায় দশ-বারো দিন আগে থেকেই শুরু হয় তার প্রস্তুতি। পুজোর আগের দিন পরিবারের বধূরা দলবেঁধে গঙ্গাজল আনতে যান। যে ঘটে জল ভরে আনা হয়, সেটিই পরদিন প্রতিষ্ঠিত করা হয় পাটে। প্রতিমা পাটে ওঠার আগে ধুমধাম করে চলে অলঙ্কার পরানোর পর্ব। একে পরানো হয় সোনা ও রূপোর গয়না। সেই কারণেই পুজোর দিনগুলিতে দেবীর গয়না পাহারা দিতে মোতায়েন থাকেন সশস্ত্র পুলিস। পাটে ওঠানোর আগে দেবীকে দেওয়া হয় ‘শীতল নৈবেদ্য’।
প্রথাটির সূচনা নিয়ে দারুণ এক কিংবদন্তী রয়েছে। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, একসময় দেবী স্বপ্নে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘জানিস তো, মর্ত্যে আগমনের পথে আমার খুব খিদে পায়। তোরা কিছু আহারের ব্যবস্থা করিস।’ সেই নির্দেশ মতো কাশীনাথের কালীকে পাটে ওঠানোর আগে নৈবেদ্য অর্পণ করা হয়। দেবীর ভোগ রান্নার অধিকার আজও একমাত্র পরিবারের বধূদের। সমস্ত পুজো আচার পালিত হয় নিশি রাতে—রাত ১২টা নাগাদ শুরু হয় মূল আরাধনা। -নিজস্ব চিত্র