• দুর্যোগের পর সোনাঝরা হাসি নিয়ে প্রাণ ফিরল পাহাড়ে! কাঞ্চনজঙ্ঘার হাসি দেখতে বাড়ছে ভিড়, কী বলছেন পর্যটকরা?...
    আজকাল | ১৬ অক্টোবর ২০২৫
  • গোপাল সাহা

    হঠাৎই যেন মেঘভাঙ্গা বৃষ্টিতে দার্জিলিং ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল। শুরু হয়েছিল মৃত্যুমিছিল আর চারিদিকে শুধু হাহাকার। যদিও আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছিল এটি মেঘভাঙ্গা বৃষ্টি নয়, প্রবল নিম্নচাপ ও ঘূর্ণাবতের কারণে এমন প্রাকৃতিক বিপর্যয়। 

    তারপর পেরিয়ে গিয়েছে প্রায় দু’সপ্তাহ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি একাধিকবার এলাকা পরিদর্শনে গিয়েছেন। যে সমস্ত এলাকাগুলি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সেদিকে বেশি করে নজর দিয়েছেন তিনি। গতকাল বুধবার আবারও সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন মানুষের বর্তমান পরিস্থিতি এবং তাদের উন্নয়নের জন্য কী কী করা যায়, রাস্তাঘাট, বসবাস, অন্নসংস্থান এবং তাদের চাকরি-বাকরির কথা চিন্তা করে। এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে তাঁরা কী খাবেন, কীভাবে থাকবেন, তাঁদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার কী হবে, সেই সব কিছুর কথা চিন্তা করে বুধবারও তিনি সেখানে পৌঁছে যান। একই সঙ্গে মমতা নজর দেন পর্যটন বিভাগের দিকেও, যাতে সেটি সচল থাকে। 

    আবহাওয়া দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলা থেকে বর্ষা বিদায় নিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ে ফিরছে সোনাঝরা রোদের আলো। আর ভ্রমণপিপাসুরাও আস্তে আস্তে ঝুঁকছেন পাহাড়ের দিকে। কারণ, দার্জিলিং মানেই এক অদ্ভুত প্রেমের শহর, ভালোবাসা শহর। আর বাঙালির ভ্রমণ দার্জিলিং ছাড়া যেন এক প্রকার অসম্পূর্ণ। প্রাকৃতিক বিপর্যয় কাটার সাত দিন যেতে না যেতেই কাঞ্চনজঙ্ঘার হাসি দেখতে আবারও মানুষের ঢল নামতে শুরু করেছে। পর্যটন ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, পর্যটকদের ভিড় যেভাবে বাড়ছে, তাতে আর কয়েক দিনের মধ্যেই টিকিট বুকিং থেকে শুরু করে হোটেল বুকিং একশো শতাংশ ছাপিয়ে যাবে সর্বত্র।

    প্রকৃতি সঙ্গ দিয়েছে ভ্রমণপিপাসুদের। দুর্যোগ কাটতেই নীল আকাশে তুলোর মতো মেঘ ভেসে চলেছে। আশ্বিনের ঝকঝকে রোদে ঝলমল করছে দার্জিলিংয়ের ম্যাল রোড। হিমেল হাওয়া ছুঁয়ে দিচ্ছে গাল। চৌরাস্তার বেঞ্চে বসে কেউ চা চুমুক দিচ্ছেন, কেউ আবার দৌড়ের উষ্ণতায় শীত ভুলে যাচ্ছেন। ঠিক সেই সময়, হোটেল থেকে একদল পর্যটক নেমে এসে ভিড় জমালেন কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে মুখ করে— শুরু সেলফি সেশন। মোবাইলের ক্যামেরায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মুহূর্ত নিজের সঙ্গে ক্যামেরা বন্দি করতে একদিকে যেমন চলছে যেমন সেলফি। অপরদিকে, পাহাড়ের পটভূমিতে হাসি-আনন্দের মুহূর্ত বন্দি করছেন তাঁরা ছবি তোলার মধ্যে দিয়ে। 

    এক মহিলা পর্যটক হাসতে হাসতে বলেন, “অনেক বছর পর পরিবারের সবাইকে নিয়ে পাহাড়ে এসেছি। রাস্তার দুরবস্থায় কষ্ট হয়েছিল বটে, কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেই সব ভুলে গিয়েছি!”

    প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে কিছুটা থমকে গিয়েছিল পাহাড়, কিন্তু ধীর লয়ে পাহাড় ফিরছে তার নিজের ছন্দে। এক গৃহবধূ বলেন, “দুর্যোগের খবর শুনে প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু স্থানীয় হোটেল মালিকের আশ্বাসে আমরা ট্যুরের তারিখ বদলে মঙ্গলবার চলে এলাম। এখন দেখে বুঝতে পারছি, ভয় কাটিয়ে পাহাড় আবার জেগে উঠেছে।”

    প্রায় দু’সপ্তাহ আগে প্রকৃতির রোষে দার্জিলিং-কালিম্পং-সিকিম জুড়ে নেমেছিল বিপর্যয়। বালাসন নদীর সেতু ভেঙে যায়, বন্ধ হয়ে যায় রোহিনী রোড, মিরিক-দুধিয়া রুটেও যানচলাচল থেমে যায়। ১০ নম্বর জাতীয় সড়কেও মেরামতির কাজ চলছে জোর কদমে। কিন্তু তার মধ্যেও থামছে না পর্যটকদের পদচারণা। দার্জিলিংয়ের ম্যাল রোড এখন আবারও সরগরম। কেউ মহাকাল মন্দিরে পুজো সেরে আসছেন, কেউ চিড়িয়াখানায় যাচ্ছেন। কেউ রাজভবন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের বাড়ি কিংবা ভানু ভবনে ঘুরে দেখছেন ইতিহাস। সন্ধ্যা নামলে আলোকিত দোকানপাটে চলছে কেনাকাটার উৎসব— পাহাড়ের হস্তশিল্প, চা, উলের পোশাকে ভরপুর বাজার।

    স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, দার্জিলিংয়ে প্রায় ১৫০০ হোটেল ও ৫০০ হোমস্টে রয়েছে। এখনই প্রায় ৫৫-৫৬ শতাংশ রুম বুকড। আর দীপাবলির আগেই সেই হার ৮৫-৯০ শতাংশে পৌঁছবে বলে আশাবাদী পর্যটন ব্যবসায়ীরা। এক পর্যটন ব্যবসায়ী বলেন, “ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর অনেকে ভেবেছিলেন পাহাড় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন পর্যটকরা। সেই ভাবনার গুড়ে বালি। সকলের সহযোগিতায় ভয় জাটিয়ে পাহাড়ে আসছে পর্যটকরা। এখন প্রায় ৫৫ শতাংশ রুম বুকিং রয়েছে। দীপাবলিতে বুকিংয়ের সেই হার আরও বাড়বে বলেই আশা করছি।” 

    দার্জিলিং হোটেল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক রেজি লামা বলেন, “বিপর্যয়ের সময় কিছু পর্যটক ট্যুর বাতিল করেছিলেন, কিন্তু অধিকাংশই নতুন করে তারিখ বদলে বুকিং রেখেছেন। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই হোটেলগুলিতে রুম পাওয়া মুশকিল। ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ভিড় থাকবে বলেই আশা করছি।”

    হোটেল বুকিং, ঘোড়ার সাফারি, ম্যাল রোডে চা-আড্ডা— সব মিলিয়ে পাহাড় এখন উৎসবের মেজাজে। পর্যটকদের এই ঢল যে শুধু দার্জিলিং নয়, গোটা উত্তরবঙ্গের অর্থনীতিকেও নতুন প্রাণ দেবে, তা বলাই বাহুল্য। স্থানীয় প্রশাসনও আশাবাদী, রাস্তা মেরামত ও পর্যটন পরিকাঠামো দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা গেলে দীপাবলির সপ্তাহে পাহাড়ে বুকিং ছুঁতে পারে শতভাগ।

    দুর্যোগের আঁচ পেরিয়ে, ভয় কাটিয়ে পাহাড় ফের প্রাণ ফিরে পেয়েছে। কাঞ্চনজঙ্ঘার নীলে আজ দার্জিলিং আবার সেই আগের মতো— হাসিখুশি, ব্যস্ত, জীবন্ত।
  • Link to this news (আজকাল)