• ৯ শতাংশ উপজাতি ভোট বিহারের জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে, তুরুপের তাস মুকেশ সাহানি...
    আজকাল | ১৭ অক্টোবর ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক: বিহারের রাজনীতির ধারাপ্রবাহ প্রায়শই নির্ধারিত হয় জাত এবং বর্ণের উপর। সেই প্রেক্ষাপটে ৪৪ বছর বয়সী মুকেশ সাহানি এক অন্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। মল্ল, সাহানি এবং নিষাদ সম্প্রদায়কে নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। বিকাশশীল ইনসান পার্টির (ভিআইপি) নেতা সাহানি তাদের আশার প্রতীক। যাদের নয় শতাংশ ভোট (২০২৩ সালের বিহার জাত সমীক্ষা অনুযায়ী) ইতিমধ্যেই জটিল রাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। মহাগঠবন্ধন তাঁকে ১৫টি আসন ছাড়তে রাজি। কিন্তু তাঁর দাবি অন্তত ২৪টি আসন। তাঁর এই দাবি কেবল ক্ষমতার জন্য আলোচনার প্রতিফলন নয়, বরং বিহারের জেলে ও নৌকাচালক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি এবং প্রতিনিধিত্বের প্রতিফলন।

    মল্ল সম্প্রদায়ের মানুষের আশার সঞ্চার ঘটিয়েছেন বলিউড থেকে রাজনীতিতে আসা একজন মানুষ। তবে, বিহারের রাজনীতির ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে, মুকেশের আখ্যান উচ্চাকাঙ্ক্ষা, বিশ্বাসঘাতকতা এবং ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষায় ভরা একটি নাটকীয় চিত্রনাট্যের মতো ফুটে উঠেছে। মুকেশের সঙ্গে শেক্সপিয়রের চরিত্র ম্যাকবেথের মিল অনেক। ম্যাকবেথের অনিয়ন্ত্রিত এবং দুঃসাহসিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাঁকে পতনের দিকে পরিচালিত করে। সাহানির হঠাৎ উত্থানের নেপথ্যে কিছু ভুল ছিল যা তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলেছিল।

    প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে কটাক্ষ করার ফলে মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার ২০২২ সালে বিহার মন্ত্রিসভা থেকে মুকেশকে (পশুপালন ও মৎস্যমন্ত্রী ছিলেন) বরখাস্ত করেন। এর পরে তাঁর কাছে সীমিত বিকল্প ছিল, হয় মহাগঠবন্ধনের একটি ইউনিট হিসেবে থাকা অথবা অন্য কোনও ছোট গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে একা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা এবং সম্ভবত রাজনীতির অতলে হারিয়ে যাওয়া।

    মল্ল সম্প্রদায় বিহার জুড়ে ছড়িয়ে আছে কিন্তু কিছু জেলা এবং নির্বাচনী এলাকায়, বিশেষ করে উত্তর বিহারে, তাদের উল্লেখযোগ্য নির্বাচনী প্রভাব রয়েছে। বিশেষ করে মিথালঞ্চল এবং সীমাঞ্চলে। পাটনা থেকে উত্তরে বৈশালী, মুজাফফরপুর, দারভাঙ্গা এবং মধুবনিতে মল্ল সম্প্রদায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভোট ব্যাঙ্ক। পূর্ব দিকে, সীমাঞ্চলের দিকে এগিয়ে গেলে খাগারিয়া, আরারিয়া, পূর্ণিয়া এবং কাটিহারে বিশাল মল্ল সম্প্রদায়ের বাস। মল্লা, নিষাদ এবং সাহানি শব্দগুলি বিহারের নদীতীরবর্তী জেলে এবং নৌকাচালক সম্প্রদায়ের উপগোষ্ঠীগুলিকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। মল্ল সম্প্রদায় নিষাদ সম্প্রদায়ের একটি উপজাতি।

    মুকেশ ‘মল্লর পুত্র’ হিসেবে পরিচিত, কিন্তু তাঁর দল নিষাদ সম্প্রদায়ের দিকে ঝুঁকে রয়েছে। নিষাদ সম্প্রদায়ে বিন্দ, বেলদার এবং কেওয়াতের মতো অনেক উপজাতি রয়েছে। অতএব, নিষাদের নয় শতাংশে মল্লা এবং সাহানি জনসংখ্যাও রয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা সাহানি-নিষাদ-মল্ল সম্প্রদায়কে ‘বর্ণ সংগঠন’ (যেমন ‘বানিয়া’) বলে অভিহিত করেন এবং বিহারে অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া শ্রেণী বিভাগের অংশ হিসেবে বিবেচিত হন। যা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৩৬.০১ শতাংশ।

    ২০২০ সালে বিধানসভা নির্বাচনে নিজের আসন থেকে হেরে যাওয়ার পরেও বিজেপির সুপারিশে মুকেশকে নীতিশ সরকারে মন্ত্রীত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাজা রক্তের উচ্চাকাঙ্খায় বিহারের বাইরেও নিজের ছাপ রাখতে চেয়েছিলেন তিনি। উত্তরপ্রদেশে কোনও উপস্থিতি না থাকা সত্ত্বেও ২০২২ সালে বিধানসভা নির্বাচনে প্রায় ৫০টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিলেন। সব প্রার্থী হেরে যান। অনেকেরে জামানতও বাজেয়াপ্ত হয়। উত্তরপ্রদেশে আদিত্যনাথ সরকারকে উৎখাতের জন্য সাহানির অবিচল দাবি বিজেপিকে তাঁর বিরুদ্ধে নিয়ে যায়। ৪ এপ্রিল বিহারের ২৪টি আসনের জন্য অনুষ্ঠিত বিধানসভা পারিষদ নির্বাচনেও মুকেশ বিজেপির বিরুদ্ধে সাতজন প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিলেন। তাঁকে ক্ষমা করেনি বিজেপি। মুকেশের দলের তিন বিধায়ক রাজু কুমার সিং (সাহেবগঞ্জ), মিস্রি লাল যাদব (আলিনগর) এবং স্বর্ণ সিং (গৌর বোরম) বিজেপিতে যোগ দেন। এর ফলে বিহার বিধানসভায় বিধায়কশূন্য হয়ে পড়েন মুকেশ। তবুও সাহানি অটল ছিলেন। তিনি বিহার মন্ত্রিসভা ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান এবং দাবি করেন যে, ২০২০ সালের রাজ্য নির্বাচনে বিজেপিকে ৭৪টি আসন জিততে সাহায্য করার ক্ষেত্রে তাঁর দলের অবদানকে খাটো করা যাবে না।

    মুকেশ জীবনে একটিও নির্বাচনে জয়ী হননি, তবে বিহারের রাজনীতিতে তাঁর উত্থান চোখে পড়ার মতো। ২০১৫ সালের নির্বাচনে তাঁকে প্রথম বিজেপির হয়ে প্রচার করতে দেখা গিয়েছিল এবং ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে তিনি আরজেডি শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর দল তিনটি আসনেই হেরে গিয়েছিল। এক বছর পর, ২০২০ সালের অক্টোবরে তেজস্বী যাদবের সাংবাদিক সম্মেলন থেকে বেরিয়ে এসে বিধানসভা নির্বাচনের মাত্র এক মাস আগে এনডিএতে যোগ দেন। বিজেপি তাদের এনডিএ কোটা থেকে মুকেশের দলকে ১১টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দেয়। মাত্র চারটি আসনে জয় আসে। যদিও মুকেশ নিজে হেরে যান। বিজেপি মুকেশকে মন্ত্রী করে এবং নীতীশ মন্ত্রিসভায় থাকার জন্য তাঁকে আইন পরিষদে পাঠায়। দল তাঁকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত এমএলসি পদ দেয়। তারপর থেকেই মুকেশ মহাগঠবন্ধনের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন।

    বিহারের রাজনৈতিক মঞ্চ হল বর্ণবাদী জোটের এক ছবি। যেখানে দলগুলি সম্প্রদায়গত আনুগত্যের উপর ভিত্তি করে পরিকল্পনা এবং কৌশল তৈরি করে। আরজেডি এবং কংগ্রেসের মতো দলগুলির সমন্বয়ে গঠিত মহাগঠবন্ধন গুরুত্বপূর্ণ সাহানি-নিষাদ-মল্ল ভোটব্যাঙ্ক সুরক্ষিত করার প্রয়োজনীয়তা বোঝে। কিন্তু, মুকেশের ২৪টি আসনের দাবি এই সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্রমবর্ধমান চেতনার প্রতিফলন। তারা আর দাবার গুটি হয়ে সন্তুষ্ট নয়। পরিবর্তে, তারা মূল খেলোয়াড় হতে চায়, যা নির্বাচনী চিত্র পাল্টে দিতে পারবে।
  • Link to this news (আজকাল)