মমতা এবং জগন্নাথ-দুর্গা-শিব, ভোটে জেতার সম্ভাবনা অনেক বেশি?
আজ তক | ১৭ অক্টোবর ২০২৫
'মানুষই দেবতা গড়ে, তাহারই কৃপার পরে, করে দেব মহিমা নির্ভর'! ভোটমুখী বঙ্গের রাজনীতিতে এই মুহূর্তে কবি কালীদাস রায়ের এই লেখাটি ভীষণ ভাবে প্রযোজ্য। এ ক্ষেত্রে কৃপা 'ভোটব্যাঙ্ক'। মন্দির গড়ে তার কৃপা কীভাবে রাজনীতিতে পাওয়া যায়, তার অঙ্ক কষা চলছে কয়েক বছর ধরেই। এবং এই স্ট্র্যাটেজির মধ্যে যে সাফল্যের বীজ রয়েছে, তা ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতে বারবার প্রমাণিত। শিলিগুড়িতে সবচেয়ে বড় শিব ও মহাকাল মন্দির গড়ার ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চুম্বকে এখন মমতা তিন দেবতার শরণে, জগন্নাথ, দুর্গা ও শিব।
চলতি বছরেই দিঘায় সুবিশাল জগন্নাথ মন্দির গড়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপরেই তিনি ঘোষণা করলেন, কলকাতায় রাজারহাটে দুর্গাঙ্গন গড়া হবে। আবার শিলিগুড়িতে মহাকাল মন্দির। হিন্দু ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি? এহ বাহ্য! সব রাজনৈতিক দলেরই তো একটাই উদ্দেশ্য, ভোটব্যাঙ্ক মজবুত করা ও ক্ষমতায় আসা। এর মধ্যে তো দোষের কিছু নেই। রাজনৈতিক ভাবে যদি বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতেই হয়, তাহলে আরেকটু গভীরে যাওয়া যাক। এখানে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি উঠে এল, তা হল 'প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা' বা Competitive Communalism।
কম্পিটিটিভ কমিউনালিজম একটি গুরুত্বপূর্ণ চলরাশি
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভময় মৈত্রের বক্তব্য, এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে যে কম্পিটিটিভ কমিউনালিজম চলছে, তা ভোটের রেজাল্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ চলরাশি বলা যায়। bangla.aajtak.in-কে ফোনে শুভময় বললেন, 'প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার বাইরেও অনেক চলরাশি আছে। যেমন লক্ষ্মীর ভাণ্ডার একটি চলরাশি। দুর্নীতি একটি চলরাশি। তেমনই প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতাও একটি চলরাশি। যে কোনও ধর্ম বা ঈশ্বর সংক্রান্ত বিষয় যখন ঘটছে, তখন দুটি জিনিস হচ্ছে। প্রথমত, যে জায়গায় এটি ঘটছে, সেই জায়গা ঘিরে হইচই হচ্ছে, আলোচনা হচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে সংখ্যাগুরু ভোটব্যাঙ্কের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করছেন, এ নিয়ে বুঝতে কিছু অসুবিধা নেই।'
মমতার দুটি অ্যাজেন্ডাই কিন্তু বিজেপির অ্যাজেন্ডার সঙ্গে মেলে
শুভময়ের মতে, 'যে হিন্দু রাষ্ট্রবাদী ভাবনা, তা সামাজিক সংগঠন হিসেবে আরএসএস ও রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে বিজেপি তো সমর্থন করে। আদর্শগত ভাবে। এবার আর কোন কোন রাজনৈতিক দল এই বিষয়টিকে সমর্থন করে? যেমন আম আদমি পার্টি বিজেপি-কে যখন হারাল, সেখানে আম আদমি পার্টির অনেক মতের সঙ্গে বিজেপির মতামত মেলে, কংগ্রেসের সঙ্গে আর্থিক নীতি মেলে, আরএসএস ও বিজেপি অত্যন্ত খুশি, কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বামপন্থীদের পশ্চিমবঙ্গে ভীষণ ভাবে দুর্বল করতে পেরেছেন। কংগ্রেসকেও ভীষণ ভাবে দুর্বল করে দিয়েছেন। এই দুটি অ্যাজেন্ডাই কিন্তু বিজেপির অ্যাজেন্ডার সঙ্গে মেলে। এবার যদি বিজেপি-র তৃতীয় অ্যাজেন্ডাটির সঙ্গেও মিলে যায়, যা হল, হিন্দু ধর্ম বা মন্দির, ঈশ্বর ভাবনা, সেগুলিও যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করেন, তা হলে আরএসএস বা বিজেপি-র তো তাঁর উপর বিরক্ত হওয়ার কথা নয়। সুতরাং একদিকে যেমন মনে হচ্ছে, মমতা এটা করে বিজেপির কাছ তার হিন্দুভোটের ভাগ নিতে চাইছেন, অন্যদিকে একটি অন্য দল হয়েও আপনার আদর্শেই বিশ্বাস করতে শুরু করি, তাহলে তো তা আখেরে আপনার কাছে লাভজনক।'
টার্গেট তো ভোটে জেতা দিনের শেষে
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংখ্যাগুরু ভোটারদের কাছে পৌঁছতে যে জগন্নাথ মন্দির, দুর্গাঙ্গন ও তারপর শিব, এই বিষয়গুলি বিজেপি-র ভাবনা ও তৃণমূলের ভোটবাক্স, এই দুটিকেই শক্ত করছে। এবং এই জায়গায় অন্য যে ইস্যুগুলি, যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জল, এইগুলি রাজনীতির আরেকটি দিকের ভাবনা। অন্য আরেক ভাবনা হল, ধর্মভিত্তিক, প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা ভিত্তিক, যা এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলছে। কারণ, তৃণমূল তো ডেটা স্টাডি না করে কাজ করছে না। এটাও রাজ্যের ভোটিং প্যাটার্ন দেখে একটি বিজ্ঞানসম্মত পরীক্ষানিরিক্ষার আউটকাম। দেখুন, টার্গেট তো ভোটে জেতা দিনের শেষে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি ও ভোটিং প্যাটার্নে দেখা যাচ্ছে, আগামী দিনে সংসদীয় গণতন্ত্রে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভূমি সংস্কার, বেকারত্বের মতো ইস্যুগুলির চেয়ে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টিতে ভোটে জেতার সম্ভাবনা অনেক বেশি ও চটজলদি রেজাল্ট পাওয়া যেতে পারে।
একটি বিজ্ঞানসম্মত ডেটার আউটকাম
শুভময় মৈত্রের কথায়, 'এই যে হিন্দুত্ববাদের প্রমোট মমতা করছেন, সেটা তো রাজনৈতিক ও আদর্শগত ভাবে বিজেপি নেতারাই বলছেন, এটা তাঁদের পক্ষে ভাল। আমার মূল বক্তব্য হল, এই যে মমতার একের পর এক মন্দিরের ভাবনা, এটি একটি বিজ্ঞানসম্মত ডেটার আউটকাম হিসেবেই করছেন। পশ্চিমবঙ্গে যে ভোটিং প্যাটার্ন, তাতে মানুষের হাতে কাজ দেওয়া, বা মাথায় ছাদ দেওয়া, রাস্তা ভাল করা বা ভাল কারখানা গড়া, কৃষি উত্পাদন বাড়ানো, এগুলি যে দরকার নেই, তা বহু বছর ধরেই, সেই বুদ্ধদেববাবুর সময়েই ফেল করেছে। মানুষ এগুলিতে ভোট দিচ্ছে না।'
সুতরাং, জগন্নাথ, দুর্গা, শিব, মন্দির তৈরি, এই বিষয়টিকে এখানে ভাল বা খারাপ, এই ভাবে সরাসরি দাগিয়ে দেওয়া যায় না। 'রোটি-কপড়া-মকান'বা উন্নয়মূলক রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডার মতোই মন্দির, মসজিদ গড়াও একটি অ্যাজেন্ডা। পুরোটাই নির্ভর করছে বাংলার মানুষের ভোটিং প্যাটার্ন বুঝে ও বিপক্ষের রাজনৈতিক দলকে হারিয়ে ভোটে জেতা। সব দলেই একটাই লক্ষ্য। মমতাও সেই পথেই আছেন।