ক্ষেতের ধারে কোন আগাছায় ফলন বাড়বে? কোন চাষে পতঙ্গদের কী ভূমিকা? জানাল নতুন গবেষণা
আনন্দবাজার | ১৭ অক্টোবর ২০২৫
বনতুলসী, কালকাসুন্দে, বজ্রমূলী থেকে শুরু করে আশশ্যাওড়া, কিংবা কালমেঘ। গ্রামবাংলার খুব চেনা কিছু গাছের নাম৷ আজকাল অবশ্য অনেকেই এদের চেনেন না। পুরনো কোনও সাহিত্য আর প্রবীণদের আলোচনাতেই তারা ‘সীমাবন্ধ’। কিন্তু, এই সব জংলি গাছ বা আগাছা যে কোনও ভাবে আমাদের খাদ্যসুরক্ষা, কৃষি উৎপাদন, প্রাণী সংরক্ষণের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত তা আবারও নতুন ভাবে উঠে এল গবেষণায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং গবেষকের সেই গবেষণা স্থান পেয়েছে ‘সায়েন্স’ পত্রিকায়। ‘ক্রিটিক্যাল হ্যাবিট্যাট থ্রেশহোল্ড ফর এফেক্টিভ পলিনেটর কনজার্ভেশন ইন এগ্রিকালচারাল ল্যান্ডস্কেপ’ শিরোনামে।
যে সমস্ত গাছ সাধারণ ভাবে আগাছা বা জংলি গাছ হিসাবে পরিচিত, যা সুযোগ পেলেই কেটে ছেঁটে সাফ করা হয় তা-ই আসলে ক্ষেতের ফলন বাড়াতে পারে৷ পলিনেটর অর্থাৎ, পরাগমিলনকারী পতঙ্গ নিয়ে দীর্ঘ দিন গবেষণা করতে করতে এমনই ভাবনা ভেবেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক পার্থিব বসু। বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন, বিশ্ব জুড়ে যেখানে মৌমাছির সংখ্যা এতটা কমে যাচ্ছে, তাদের সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কতটা জরুরি হয়ে উঠতে পারে আমাদের চারপাশে অবহেলায় বেড়ে ওঠা ‘ঝোপঝাড়’। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যা ‘সেমি ন্যাচারাল হ্যাবিট্যাট’।
পার্থিবের পথ অনুসরণ করে তাঁর গবেষক-ছাত্র সুপ্রতিম লাহা গবেষণা শুরু করেছিলেন ওড়িশার পঞ্চলিঙ্গেশ্বরে। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের কাজ ছিল, সেমি ন্যাচরাল হ্যাবিট্যাটে কোন কোন আগাছা (নন ক্রপ প্লান্ট) উপকারী পতঙ্গদের আকৃষ্ট করে এবং কোন কোন গাছ প্রাকৃতিক ট্র্যাপ প্লান্ট অর্থাৎ ক্ষতিকারক পোকামাকড় আকৃষ্টকারী উদ্ভিদ হিসাবে কাজ করে তা বোঝার চেষ্টা করা। আমরা দেখতে পাই এমন একাধিক জংলি গাছ রয়েছে, যা মৌমাছিদের বিপুল ভাবে আকৃষ্ট করে! তারপর সেই গাছগুলিকে নিয়ে আমরা একটা পরীক্ষাও চালাই।’’
কেমন ছিল সেই ‘পরীক্ষা’? সুপ্রতিম জানান, পরীক্ষামূলক ভাবে বিভিন্ন ফসলের ক্ষেতের পাশে সেই সমস্ত উপকারী জংলি গাছ বসিয়ে দেখা যায়, সেই সমস্ত ক্ষেতে আরও বেশি সংখ্যক এবং বেশি ধরনের মৌমাছি আকৃষ্ট হচ্ছে এবং ক্ষতিকারক পতঙ্গের আক্রমণ কমছে! তাঁর কথায়, ‘‘আনাজের ক্ষেতে যখন সব্জি থাকে না, তখন এই সমস্ত আগাছার ফুলই মৌমাছিদের মতো পলিনেটরদের বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। তাই চাষের ক্ষেতে যখন ফলন থাকে না, তখন ওয়াইল্ড পলিনেটরদের আমরা এই সমস্ত সেমি ন্যাচরাল হ্যাবিট্যাট রাখার মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখতে পারি। তাই ঝোপঝাড় কেটে সাফ করে দিলে আদতে তা আমাদের চাষের ফলনেই খারাপ প্রভাব ফেলে। এ বার, কোন আগাছা কোথায় কতটা থাকা উচিত, কোনটা উপকারী পতঙ্গদের আকৃষ্ট করবে, কোনটা ‘ট্র্যাপ প্লান্ট’ (‘ন্যাচারাল পেস্ট কন্ট্রোল’ বা প্রাকৃতিক পদ্ধতির সাহায্যে ক্ষতিকারক পতঙ্গ নির্মূলকরণ) হিসাবে কাজ করবে সেই মাত্রা নির্ধারণটাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ।’’
তবে বৃহত্তর ক্ষেত্রে এই সমস্ত জংলি গাছের উপকারিতা পাওয়ার জন্য শুধুমাত্র ক্ষেতের পাশে এদের বসালেই কাজ হয় না বলে গবেষণাপত্রে জানিয়েছেন সুপ্রতিমেরা। এ ক্ষেত্রে, মোট চাষজমির পরিমাণের উপরে নির্ভর করে ওই এলাকা পিছু ঠিক কতখানি ঝোপঝাড় অর্থাৎ, সেমি ন্যাচরাল হ্যাবিটাট থাকা দরকার। এ ছাড়া, ওই এলাকায় মৌমাছি, প্রজাপতি, হভার ফ্লাইয়ের (এক ধরনের মাছি) মতো পরাগমিলকারী পতঙ্গের উপস্থিতি বুঝে ঠিক করা উচিত ওই সমস্ত ঝোপঝাড়ে কোন কোন গাছ বাঁচিয়ে রাখা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, ওদের উপরেই নির্ভর করে পরাগমিলনকারী পতঙ্গদের অস্তিত্ব এবং সংখ্যা। নেদারল্যান্ডসের ওয়াগাহনিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক গ্যাব্রিয়েলা বিশপ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষণা সম্পর্কে জানতে পেরে যোগাযোগ করেছিলেন অধ্যাপক পার্থিবের সঙ্গে। তার পর তাঁরা শুরু করেন মেটাঅ্যানালিসিসের কাজ। তিনিই বিশ্বজুড়ে ১৯টি দেশের মোট ৫৯টি গবেষণাকে এক সূত্রে বাঁধেন। ‘ক্রিটিক্যাল হ্যাবিট্যাট থ্রেশহোল্ড ফর এফেক্টিভ পলিনেটর কনজার্ভেশন ইন এগ্রিকালচারাল ল্যান্ডস্কেপ’ গবেষণাপত্রটি সেমি ন্যাচরাল হ্যাবিট্যাট ও বেনিফিশিয়াল ইনসেক্টদের পারস্পরিক প্রয়োজনীয়তা ও সম্পর্ক সংক্রান্ত সেই সমস্ত গবেষণার একটি ‘মেটা অ্যানালিসিস’। ‘সায়েন্স’ পত্রিকার সেপ্টেম্বর সংখ্যায় সেটি প্রকাশিত হয়েছে। ঘটনাচক্রে, অধ্যাপক পার্থিবের অকাল প্রয়াণের ঠিক ১০ মাস পরে।
সুপ্রতিম জানান, ট্রপিক্যাল অর্থাৎ, ক্রান্তীয় অঞ্চলে এই বিষয়ে গবেষণা হয়েছে মাত্র তিনটি। তাঁর কাজটি ওই তিনটির মধ্যে অন্যতম। এই গবেষণাপত্রের আলোচনায় দেখা গিয়েছে, সোশ্যাল বি, সলিটারি বি, হভার ফ্লাই এবং প্রজাপতির সংখ্যা বাড়ানোর জন্য কতটা চাষের জমির নিরিখে ঠিক কতটা করে ঝোপঝাড় থাকা প্রয়োজন। দেখা গিয়েছে, ট্রপিক্যাল বা ক্রান্তীয় অঞ্চলে সলিটারি বি এবং বাম্বল বি (সোশ্যাল বি)-এর বেঁচে থাকার জন্য মোট চাষের জমির প্রায় ৩৮ শতাংশ ঝোপঝাড় থাকা উচিত। পাশাপাশি, সেখানে শুধুমাত্র এক ধরনের আগাছা থাকলেই হবে না, থাকতে হবে বিভিন্ন ধরনের সপুষ্পক আগাছা। প্রজাপতির জন্যেও জমির নিরিখে আগাছা থাকা প্রয়োজন প্রায় ৩৭ শতাংশ। আবার হভার ফ্লাইয়ের বেঁচে থাকার জন্য ঝোপঝাড়ের পরিমাণ মাত্র ৫ শতাংশ হলেই চলে। তিনি জানান, বাংলার গ্রামে ঝোপঝাড় আলাদা করে রেখে দেওয়ার কথা কৃষকেরা ভাবতেই পারেন না। সব জমিই চাষের কাজে লাগিয়ে ফলন বাড়াতে চান। দেশজ আগাছা উদ্ভিদ উধাও হওয়ায় মৌমাছির মতো পরাগমিলনকারী এবং অন্যান্য উপকারী পতঙ্গের সংখ্যা কমছে। যার জেরে ফলন কমছে আনাজ, সব্জিরও। সেমি ন্যাচরাল হ্যাবিট্যাট না রাখা যে আদতে ফলনেই খারাপ প্রভাব ফেলে, তা বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত। তাই, পতঙ্গ সংরক্ষণের কথা না ভাবলেও ভবিষ্যতে নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আগাছার প্রতি আরও যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন।