হুঁশিয়ারি ১: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, বাংলায় এসআইআর-এর নামে এনআরসি করার চক্রান্ত হচ্ছে। তিনি রাস্তায় নেমে রুখবেন!
হুঁশিয়ারি ২: বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া বনগাঁয় দলের বিজয়া সম্মিলনীতে যোগ দিতে গিয়ে ব্যারাকপুরের তৃণমূল সাংসদ পার্থ ভৌমিক বলেছেন, ‘‘এসআইআরে যদি এক জনও বৈধ ভোটারের নাম বাদ যায়, তা হলে পাড়ার বিজেপি নেতাদের আমরা আটকে রাখব।’’
হুঁশিয়ারি ৩: এসআইআর নিয়ে হুঙ্কার দিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার সংখ্যালঘু মুসলিমদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘‘যদি ভাঙচুর করেন, দোকানঘর পোড়ান, বাড়িতে আক্রমণ করেন, তৃণমূলের কোনও নেতার ছেলের জীবন যাবে না। কেন্দ্রীয় বাহিনী নামলে কিন্তু গুলি চলবে! আপনার বাড়ির লোকেদের গুলি লাগবে। তৃণমূলের নেতারা এসি ঘরে বসে থাকবেন। তাঁদের গুলি লাগবে না। তাই তৃণমূলের ফাঁদে পা দেবেন না।’’
হুঁশিয়ারি ৪: এসআইআরে ‘বৈধ’ ভোটারের নাম বাদ গেলে দিল্লির নির্বাচন সদন ঘেরাওয়ের কথা আগেই বলে রেখেছিলেন মমতা। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতা সুদীপ রাহা পূর্ব মেদিনীপুরে দলীয় কর্মসূচিতে বলেছেন, ‘‘এক জন বাংলার মানুষের নাম বাদ গেলেও আমরা এক লক্ষ লোক নিয়ে শুভেন্দু অধিকারীর বাড়ি ঘেরাও করব।’’
বিষয় এসআইআর। সেই একটি বিষয়কেই কেন্দ্র করে উপরে উল্লিখিত হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তৃণমূল এবং বিজেপির নেতানেত্রীরা। যা থেকে দু’টি বিষয় স্পষ্ট। প্রথমত, এসআইআর-কে কেন্দ্রীয় সাহায্য নিয়েই বাংলায় ‘কার্যকর’ করতে চাইছে পদ্মশিবির। কখনও তা নির্বাচন কমিশন, কখনও তা কেন্দ্রীয় বাহিনীর মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত, তৃণমূল তা প্রতিরোধ করতে চাইছে নিচুতলার সাংগঠনিক শক্তি দিয়ে।
প্রসঙ্গত, মমতার হুঁশিয়ারি ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। একটি হিন্দি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে তাঁকে ওই হুঁশিয়ারি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে নিশ্চিন্ত এবং নির্লিপ্ত ভাবে সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়েছেন শাহ, ‘‘বিহারে এসআইআরের সময়েও এমন অনেক কিছু বলা হয়েছিল। বিহারে এসআইআর হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও হবে।’’
বিজেপি-তৃণমূলের মধ্যে এই ধরনের লড়াই নতুন নয়। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোট হোক বা ২০২৪ সালের লোকসভা ভোট— দু’টি ক্ষেত্রেই বিজেপি ভরসা করেছিল কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপর। আর তৃণমূলের শক্তি ছিল বুথস্তরের সাংগঠনিক শক্তি এবং নির্বাচনের দিন ‘টি-টোয়েন্টি’ খেলার মেজাজ। দু’টি ক্ষেত্রেই তৃণমূল জিতেছিল। নির্বাচনের ফলাফল বলেছিল, কেন্দ্রীয় বাহিনীর তুলনায় তৃণমূলের বুথের বাহিনী দাপট বেশি দেখিয়েছিল। তবে বিজেপির পাল্টা বক্তব্যও রয়েছে। পদ্মশিবিরের বক্তব্য, তৃণমূল যাকে ‘সাংগঠনিক শক্তি’ বলে জাহির করতে চাইছে, তার সবটাই পুলিশের ভরসায়। পুলিশ সরে গেলে তৃণমূল লাটে উঠে যাবে!
অনেকের অবশ্য বক্তব্য, এসআইআর নিয়ে দু’দলের নেতারা প্রকাশ্যে যা বলছেন, তা সবই কর্মী-সমর্থকদের উজ্জীবিত করতে। যাতে ভোটের আগে মনোবল না ভাঙে। নেপথ্যের বিষয়টি কেউ প্রকাশ্যে বলছেন না। তা হল এসআইআর কার্যকর করার সরকারি ব্যবস্থা। তৃণমূলের প্রথম সারির অনেক নেতাই একান্ত আলোচনায় বলছেন, বিহারে যে ভাবে গণহারে নাম বাদ দিতে পেরেছে কমিশন (বিহারে সর্বশএষ কাটাকুটির পরে ওই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৪৭ লক্ষে), তা বাংলায় সম্ভব হবে না। তাঁদের বক্তব্য, বিহারে সরকারি ব্যবস্থা নীতীশ কুমার এবং বিজেপির ‘নিয়ন্ত্রণে’ ছিল। ফলে আমলা এবং আধিকারিকতন্ত্রকে ব্যবহার করা গিয়েছে। বাংলায় পরিস্থিতি ঠিক তার উল্টো। একই ভাবে বিহারে বুথস্তরের সংগঠনে বিজেপি এবং সংযুক্ত জনতা দলের যা শক্তি, সেই শক্তি বিরোধীদের কারও নেই। বিহারের বুথস্তরে আরজেডি, কংগ্রেসের যেমন করুণ অবস্থা, বাংলায় তেমন পরিস্থিতি বিজেপির। যার পাল্টা বিজেপির যুক্তি, প্রক্রিয়া মেনে কাজ না-করলে যে কমিশন এ বার কঠোর ব্যবস্থা নেবে, তা চার আধিকারিককে নিলম্বিত (সাসপেন্ড) করার মধ্য দিয়েই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিজেপি মনে করছে, সরকারি ব্যবস্থাকে ব্যবহার করা এ বার অত সহজ হবে না। বরং প্রয়োজনে কমিশন বাঁকা আঙুলে ঘি তুলবে।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মোট ৪২টি আসনে যে ভোটার তালিকা মেনে ভোট হয়েছিল, তার মধ্যে ১৪ লক্ষ নাম ‘ডুপ্লিকেট’ ছিল বলে প্রশাসনিক মহলের খবর। সেই নামগুলি বাদ পড়বেই বলে বিজেপির আশা। তবে তাদের আশা, ঠিকমতো এসআইআর প্রয়োগ করলে বাদ-পড়া নামের সংখ্যা কোটিতে পৌঁছে যাওয়া উচিত।
তৃণমূল ইতিমধ্যেই এসআইআর নিয়ে সাংগঠনিক ভাবে ময়দানে নেমে পড়েছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে এসআইআর-এর সময়ে সংগঠনকে কী ভাবে নামানো হবে, সেই মর্মে ‘বিশেষ বার্তা’ পাঠিয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এসআইআর-এর ক্ষেত্রে এ বার স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাঁদের মধ্যে তৃণমূলের নিয়ন্ত্রণই বেশি। যা তৃণমূলের জন্য ‘স্বস্তিদায়ক’ বলে মনে করছেন শাসকদলের নেতারা। একটা সময়ে প্রাথমিক এবং উচ্চ প্রাথমিক স্তরে শিক্ষকদের মধ্যে বামেদের সংগঠন এবিপিটিএ এবং এবিটিএ ছিল নিয়ন্ত্রক। যার ফয়দা নির্বাচনের রাজনীতিতে পেত সিপিএম। ২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটের সময়ে নির্বাচন কমিশন একাধিক কড়া পদক্ষেপ করেছিল। সেই পর্বে আলিমুদ্দিন পরিকল্পনা করেই শিক্ষক এবং কর্মচারী সংগঠনকে ব্যবহার করেছিল। ফলও পেয়েছিল তারা। সেই তত্ত্বেই তৃণমূলের অনেকে মনে করছেন, ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ নিয়ে যতটা গর্জন হচ্ছে, ততটা বর্ষণ হবে না।
বাংলার ভোটার তালিকায় বিপুল সংখ্যক মৃত ভোটারের নাম রয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, বিধানসভা পিছু সেই সংখ্যা অন্তত ১২-১৫ হাজার। আবার বহু জায়গায় তৃণমূলের জয়ের ব্যবধান ১২-১৫ হাজার বা তার কম। বিরোধীদের এ-ও অভিযোগ, এই মৃত ভোটারদের ভোটের সুবাদেই বহু জায়গায় টিকে রয়েছে তৃণমূল। সত্যিই কি তাই? শাসকদলের বড় অংশ এই নির্দিষ্ট প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গেলেও তাদের বক্তব্য, বুথের সাংগঠনিক শক্তিতে তৃণমূলকে কেউ হারাতে পারবে না। আসল বিষয় সেটাই।
এসআইআরের ক্ষেত্রেও সেই সাংগঠনিক বাহিনীকেই মাঠে নামানোর পরিকল্পনা করেছে তৃণমূল। পক্ষন্তরে, বিজেপির ভরসা কমিশন, কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং আদালত। আগের দু’বার বাহিনীর লড়াইয়ে জিতেছে তৃণমূল। ২০২৬ সালে আবার বাহিনী বনাম বাহিনী। প্রশাসনিক বাহিনী বনাম সাংগঠনিক বাহিনী।