আরও ২৯ হাজার কোটির ঋণ নিচ্ছে নবান্ন! ‘বিপদ’ দেখছে বিজেপি, ‘শঙ্কা’ উড়িয়ে মোদী সরকারকেই নিশানা তৃণমূলের
আনন্দবাজার | ১৭ অক্টোবর ২০২৫
আবার ‘মোটা’ ঋণ নিতে চলেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। এতে রাজ্যের অর্থনীতিতে ‘অন্ধকার ভবিষ্যতের’ ইঙ্গিত দেখছে প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। যদিও তৃণমূলের যুক্তি, কেন্দ্র নানা খাতের বিপুল টাকা আটকে না-রাখলে এত ঋণ নেওয়ার দরকারই পড়ত না। রাজ্যের শাসকদলের আরও বক্তব্য, নিজেদের সামর্থ্য বুঝে এবং ‘সীমা’র মধ্যে থেকেই এগোচ্ছে সরকার।
চলতি অর্থবর্ষের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে (অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর) বাজার থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে ঋণ নেবে তার পরিমাণ ২৯ হাজার কোটি টাকা । অর্থ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, এই নতুন ঋণ নেওয়ার পর শুধু চলতি বছরেই বাজার থেকে নেওয়া ঋণের অঙ্ক দাঁড়াবে প্রায় ৭৮ হাজার কোটি টাকায়। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনুমান, চলতি অর্থবর্ষের শেষে এক বছরে রাজ্যের নেওয়া মোট বাজারঋণ এক লক্ষ কোটি টাকাও ছুঁতে পারে।
ঋণ নেওয়ার এই প্রবণতায় বিপদ দেখছে বিরোধীদল বিজেপি। তাদের কথায়, ঋণ নিয়ে সরকার সম্পদ উৎপাদন না-করায়, আগামী দিনে মহাসঙ্কটে পড়বে পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্য সরকার এই অভিযোগ মানছে না। পাল্টা যুক্তিও রয়েছে তাদের তরফে। রাজ্যের ঘনিষ্ঠ অর্থনীতিবিদেরাও বলছেন, পরিস্থিতি অনুযায়ী ঋণ নেওয়ার পরিমাণ এবং পদ্ধতি না-দেখে কোনও সরল বিশ্লেষণ করে ফেলা যায় না।
২০২৫-২৬ (চলতি) অর্থবর্ষের রাজ্য বাজেটে বাজারঋণ ধার্য ছিল ৮২ হাজার কোটি টাকার মতো। কিন্তু নতুন প্রকল্প চালু করা এবং কেন্দ্রীয় অনুদান সময়মতো না-আসার কারণে রাজ্যের নিজস্ব ব্যয় বেড়ে গিয়েছে বলে দাবি নবান্নের। অর্থ দফতরের এক আধিকারিক বলেন, “কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলির তহবিল নির্দিষ্ট সময়ে না-পৌঁছনোর ফলে রাজ্যকে নিজস্ব অর্থে অনেক প্রকল্প এগিয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে। ফলে রাজস্ব আয় বাড়লেও ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্রুত হারে, যার ফলে ঋণনির্ভরতা অনিবার্য হয়ে পড়ছে।”
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষ পর্যন্ত রাজ্যের মোট দেনার পরিমাণ ছিল ৬.৩৩ লাখ কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ সালে তা বেড়ে ৭ লক্ষ কোটি ছাড়িয়েছে। আর ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষে এই অঙ্ক ৮ লক্ষ কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছোতে পারে বলে মনে করছে বিজেপি পরিষদীয় দল। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর অভিযোগ, বিপুল ঋণের চাপে নানা জনবিরোধী প্রক্রিয়ায় টাকা তোলার পথে যাচ্ছে সরকার। তাঁর বক্তব্য, ‘‘৮ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ করা রাজ্য সরকার টোটো নিবন্ধনের নামে টাকা তুলতে চায়। ইডি, সিবিআইয়ের গুঁতোয় চিট ফান্ড বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন রাজ্য সরকার মূলত মদ-নির্ভর। সামনে নির্বাচন। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে আবার কিছু দান-খয়রাতি করতে হবে। ১০০-২০০ টাকা ভাতা বাড়াতে হবে। খরচ আছে।’’ বিজেপি একই সঙ্গে মনে করছে, রাজস্ব আয়ের তুলনায় ঋণবৃদ্ধির হার অনেক বেশি হওয়ায় আগামী দিনে রাজ্যের উপর ঋণশোধের চাপ আরও বাড়বে।
বিজেপি বিধায়ক তথা পেশায় স্কুলশিক্ষক অরূপ দাসের কথায়, ‘‘যে কোনও সরকারকে প্রয়োজনে বিভিন্ন সময় বাজার থেকে ঋণ নিতে হয়। কিন্তু কথা হচ্ছে রাজ্য সরকার সেই ঋণ নেওয়া অর্থ কী ভাবে কাজে লাগাবে? ঋণের অর্থের একটি অংশ যদি আমরা উৎপাদন সংক্রান্ত কোনও কাজে ব্যবহার না-করতে পারি, তা হলে আজকের ঋণ আগামী দিনের বোঝা বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।’’ অরূপের মতে, ‘‘শুধুমাত্র রোজকার বাজারহাট করার জন্য ঋণের টাকা ব্যবহার করা উচিত নয়। ভাতা দেওয়ার জন্য যদি ঋণকে ব্যবহার করা হয়, তা হলে সেখান থেকে উৎপাদন সংক্রান্ত কোনও বিষয় রাজ্য পাবে না। ঋণের মাধ্যমে যদি কোনও সম্পদ সৃষ্টি না-করা যায় তা হলে যে ঋণ নেওয়া হচ্ছে তা শোধ করা যাবে কী ভাবে?’’
বিজেপি বিধায়ক আঙুল তুলেছেন ‘খেলা-মেলা’-র দিকেও। তাঁর কথায়, ‘‘সম্পদ সৃষ্টি না-করে যদি খেলা, মেলা কিংবা ভাতা দেওয়ার কাজে ঋণের অর্থ ব্যবহার করা হতেই থাকে, তা হলে তো রাজ্যের ওপর ঋণের বোঝা বেড়েই চলবে। আমরা দেখছি রাজ্য সরকার কেবলমাত্র ভোট বৈতরণী পার করার জন্য ঋণের অর্থে খেলা, মেলা, ভাতা ইত্যাদির কাজে ব্যবহার করছে। আর দিন দিন রাজ্যের অর্থনীতি গোল্লায় যাচ্ছে। এক কথায় যদি বলতে হয় তা হলে রাজ্যের অর্থনীতিকে রাজ্য সরকার ক্রমশ কোমার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।’’
ঋণ নেওয়ার বিষয়টিকে এত নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে নারাজ অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার। তিনি বলছেন, ‘‘দেখতে হবে ঋণের সঙ্গে রাজ্যের জিএসডিপি অর্থাৎ গ্রস স্টেট ডোমেস্টিক প্রোডাক্টের (রাজ্যের মোট উৎপাদনের) অনুপাতটা। সেটা কি বেড়েছে? সেটা তো বাড়েনি। সিপিএম আমলে এটা ৪৫ শতাংশ হয়ে গিয়েছিল। পরে সেটি কমে ৪২ শতাংশ হয়েছিল আর এখন মনে হয় ৩৭ বা ৩৮ শতাংশ হয়েছে।’’ অভিরূপের কথায়, ‘‘অতএব খুব সহজ কথা যে— রাজ্যের হাতে যদি বেশি টাকা থাকে, তা হলে আমি বেশি ঋণ নিতে পারব। একটা বড় কোম্পানি তো সব সময় বেশি ঋণ নেয়। কারণ তাদের টাকা ফেরত দেওয়ার ক্ষমতা আছে। তাই ৮ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ দেখে তো আর সব কিছু বোঝা যাবে না। দেখতে হবে আয় কতটা বেড়েছে, আর তার অনুপাতে ঋণের পরিমাণ কতটা বেড়েছে। এবং সেটা খুব একটা বেড়েছে বলে আমরা মনে হয় না।’’
নবান্ন এবং শাসকদলের দাবি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকারের পক্ষ থেকে রাজ্যের পাওনা আটকে রাখাই এই ঋণবৃদ্ধির বড় কারণ। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা প্রকল্পে কেন্দ্রীয় অনুদান না-পাওয়ায় রাজ্য সরকার নিজস্ব উদ্যোগে ‘বাংলার বাড়ি’ প্রকল্প চালু করেছে। যার ফলে অতিরিক্ত প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। তা ছাড়া, গত দু’বছর ধরে কেন্দ্রীয় সরকার ১০০ দিনের প্রকল্পের মজুরি না-দেওয়ায় রাজ্য নিজস্ব খরচে প্রায় ৩,৭০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে প্রায় ২১ লক্ষ শ্রমিকের বকেয়া পরিশোধে। এ ছাড়াও রাজ্যের নতুন কর্মসূচি ‘আমাদের পাড়া আমাদের সমাধান’-এর ক্ষেত্রেও বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে। প্রতি বুথে ১০ লক্ষ টাকা বরাদ্দের এই প্রকল্পে মোট ব্যয় হবে কমপক্ষে ৮,০০০ কোটি টাকা, যার ফলে রাজ্যের আর্থিক ভার আরও বাড়ছে। তাতেই অর্থবছরের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে বাজার থেকে ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন হয়েছে।
রাজ্যের অর্থ প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এ রাজ্যের বিজেপির দিকে পাল্টা আঙুল তুলে বলছেন, তাদের উচিত রাজ্যের স্বার্থে কেন্দ্রের ‘বঞ্চনা’ নিয়ে একসঙ্গে লড়াই করা। একই সঙ্গে তিনি জানাচ্ছেন, ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে ‘সীমা’ অতিক্রম কখনওই করে না তাঁদের সরকার। চন্দ্রিমার বক্তব্য, “কেন্দ্র আমাদের ন্যায্য পাওনা আটকে রেখেছে। তবুও আমরা নির্ধারিত সীমার মধ্যে থেকেই ঋণ নিচ্ছি। কোনও নিয়ম ভাঙা হয়নি। জনগণের উন্নয়নই আমাদের অগ্রাধিকার।” তিনি আরও বলেন, ‘‘যাঁরা বলছেন রাজ্য সরকার ঋণ নিয়ে খারাপ কাজ করছে, তা হলে তাঁরা রাজ্য সরকারের সঙ্গে সুর মিলিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে পাওনা আদায় করে দিন। তা হলেই রাজ্য সরকারকে ঋণ নিতে হয় না।’’