• মাইক্রো-ফাইন্যান্স ব্যবস্থার রমরমা কমাতে ব্যর্থ নীতীশ কুমার ...
    আজকাল | ১৮ অক্টোবর ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক: মাত্র চার মিটার বাই তিন মিটারের একটি ছোট ঘরে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল সিয়ারাম সাহুর দেহ। পাটনা শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে, পালিগঞ্জ মহলের কাব গ্রামে এই ঘটনায় আজও শোক সামলাতে পারছেন না তাঁর মা মহান্তি দেবী। দুই মাস কেটে গেছে, কিন্তু ছেলের মৃত্যুর শোক ও অবিচারের বেদনা তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

    সিয়ারাম সাহু ছিলেন এক জন দিনমজুর। স্ত্রী টিটলি দেবী ও চার সন্তান নিয়ে সেই ঘরেই বাস করতেন। টিটলি দেবী তাঁর মেয়ের বিয়ের জন্য একটি মাইক্রো-ফাইন্যান্স সংস্থা থেকে ৫০,০০০ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। এখনো প্রায় ১৪,০০০ টাকা বাকি রয়েছে। পরিবারের অভিযোগ, সংস্থার কালেকশন এজেন্টের লাগাতার হয়রানি ও অপমানই সাহুর আত্মহত্যার মূল কারণ।

    ঘটনার দিন রাতে, কালেকশন এজেন্ট এসে দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করে এবং টাকা ফেরতের জন্য হুমকি দিতে থাকে। আতঙ্কে টিটলি দেবী বাইরে গিয়ে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করার চেষ্টা করেন। এই ফাঁকে এজেন্ট নাকি সাহুকে অপমান করতে থাকে এবং ভয় দেখায়। পরিবারের দাবি, তখনই সাহু প্রশ্ন করেন—"আমি যদি টাকা দিতে না পারি, তাহলে মরেই যাই?"—এজেন্ট নাকি ঠান্ডা মাথায় জবাব দেয়, “হ্যাঁ, মরে যাও।” কিছুক্ষণের মধ্যেই সাহু নিজের প্রাণ দেন।

    টিটলি দেবীর কথায়, তাঁর স্বামী যখন আত্মহত্যা করেন, তখনও সেই এজেন্ট ঘরের বাইরে বসে ছিল। কিন্তু মৃত্যুর দৃশ্য দেখে সে পালিয়ে যায়। প্রতিবেশীরা এসে সাহুকে মৃত অবস্থায় দেখতে পান। অথচ দুই মাস কেটে গেলেও আজ পর্যন্ত পুলিশ না কোনো এফআইআর নিয়েছে, না পরিবারের হাতে পৌঁছেছে পোস্টমর্টেম রিপোর্টের কপি। শুধু দৈনিক ভাস্কর হিন্দি-র একটি সংবাদের ফুটনোটে স্থান পেয়েছিল এই মর্মান্তিক ঘটনা, সেটিও স্থানীয় বিধায়ক সন্দীপ সিংহের মাইক্রো-ফাইন্যান্স সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ মিছিলের প্রসঙ্গে।

    এই মৃত্যু কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং এটি বিহারের মাইক্রো-ফাইন্যান্স অর্থনীতির ভিতরে লুকিয়ে থাকা গভীর কাঠামোগত হিংসার  প্রতিচ্ছবি। বিগত এক দশকে রাজ্যটি ভারতের অন্যতম বৃহৎ মাইক্রো-ফাইন্যান্স বাজারে পরিণত হয়েছে। মহিলাদের  ক্ষমতায়নের নামে গড়ে ওঠা এই অর্থনীতি আজ ঋণের চক্রে বন্দি করে ফেলেছে হাজারো পরিবারকে।

    নীতীশ কুমার সরকারের নানা প্রকল্প—যেমন জীবিকা প্রকল্প, জীবিকা দিদি নেটওয়ার্ক, মুখ্যমন্ত্রী নারী শক্তি যোজনা—নিয়ে প্রশাসন দীর্ঘদিন ধরে গর্ব করে আসছে। সরকার দাবি করে, এসব প্রকল্প নাকি মহিলাদের  আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও উদ্যোক্তা সৃষ্টির পথ খুলে দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই উদ্যোগগুলি দরিদ্র মহিলাদের  ঋণনির্ভর বাজারে ঠেলে দিচ্ছে, যেখানে ঝুঁকির ভার সম্পূর্ণ তাঁদের কাঁধে।

    গ্রামীণ এলাকায় ঋণ আদায়কারীদের ভূমিকা আরও নির্মম। কমিশনের ভিত্তিতে কাজ করা এই এজেন্টরা প্রায়শই রাতের বেলায় দরজায় আসে, অপমান করে, হুমকি দেয়, এমনকি সামাজিকভাবে লজ্জিত করার পথও বেছে নেয়। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার একাধিক রিপোর্টে উল্লেখ আছে যে, বিহারের গ্রামীণ ও আধা-শহুরে এলাকায় এসব এনবিএফসি (Non-Banking Financial Companies)-র কার্যকলাপের উপর পর্যাপ্ত নজরদারি নেই এবং অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থাও কার্যত অনুপস্থিত।

    তবুও সরকারী প্রচারে মাইক্রো-ফাইন্যান্সকে মহিলাদের  আত্মনির্ভরতার প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়। বাস্তবে এই "আত্মনির্ভরতা" এক ঋণ-নির্ভরতা—যেখানে সুদের হার ২৯ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ফলে, সামান্য আয়ের মহিলা  ও পরিবারগুলো আরও গভীর ঋণচক্রে আটকে পড়ছে।

    এমনকি অনেক মহিলারাই  এখন সরকারের এক অদৃশ্য প্রশাসনিক হাতিয়ার হয়ে উঠেছেন। তাঁদের কাজ শুধু ঋণ বিতরণ নয়, সহকর্মীদের কাছ থেকেও ঋণ আদায় নিশ্চিত করা। এভাবেই ঋণ শোধ করাকে গৌরব ও দায়িত্বের প্রতীক বানানো হচ্ছে, আর সমাজকে শেখানো হচ্ছে যে ঋণ পরিশোধই নাকি ক্ষমতায়নের মাপকাঠি। কিন্তু যখন ঋণের বোঝা অসহনীয় হয়ে ওঠে, তখন রাষ্ট্রের উপস্থিতি মিলিয়ে যায়—যেমন তিতলি দেবীর জীবনে ঘটেছে।

    সিয়ারাম সাহুর মৃত্যু তাই এক ব্যক্তিগত বিপর্যয় নয়, বরং একটি সামাজিক পরাজয়ের প্রতীক। রাজ্য সরকার যদি সত্যিই নারী সুরক্ষা ও উন্নয়নে বিশ্বাসী হয়, তবে তাকে প্রতীকী "ক্ষমতায়ন"-এর রাজনীতি ছেড়ে বাস্তব সংস্কারের পথে হাঁটতে হবে।

    প্রথমত, মাইক্রো-ফাইন্যান্স সংস্থাগুলির উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ঋণগ্রস্ত পরিবারগুলির জন্য জরুরি সহায়তা তহবিল ও মানসিক পরামর্শের ব্যবস্থা করতে হবে। আর তৃতীয়ত, উন্নয়নের ভাষাকে পুনরায় রাজনৈতিক করে তুলতে হবে—যেখানে মর্যাদা, নিরাপত্তা ও জীবনের অধিকার ঋণের সুদের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে।

    মহিলাদের  প্রকৃত ক্ষমতায়ন তখনই সম্ভব, যখন তাঁরা ভয়ের নয়, স্বাধীনতার সঙ্গে বাঁচতে পারবেন—যখন তাঁদের জীবন আর “ঋণের মর্যাদা” নয়, মানবিক মর্যাদার ভিত্তিতে গড়ে উঠবে।
  • Link to this news (আজকাল)