সংবাদদাতা, ঘাটাল: ক্ষীরপাই পুরসভার ১নম্বর ওয়ার্ডের কেঠিয়া খালের পাড়ে রয়েছে এক অসাধারণ কালীমন্দির। মন্দিরে রয়েছে ৩৫ ফুট উচ্চতার কংক্রিটের তৈরি বিশাল কালীমূর্তি। দেবী এখানে ভক্তদের কাছে ‘বড়মা’ নামে পরিচিতা। মন্দিরটি স্থানীয়দের পাশাপাশি তিন-চারটি জেলা এবং আসাম ও বাংলাদেশ থেকে আসা বিপুল ভক্তসমাগমের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। মন্দিরে নেই কোনও পুরোহিত, দক্ষিণাও লাগে না। এখানে নিজের পুজো নিজেকেই দিতে হয়। মানুষের বিশ্বাস, বড়মার কাছে যা কামনা করা হয়, তা-ই পূরণ হয়। তাই বড়মার আশীর্বাদ লাভের আশায় জেলা, রাজ্য এবং দেশ ছাড়িয়ে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ছুটে আসেন। এবছর এই মন্দিরের কালীপুজো ২৪ বছরে পদার্পণ করবে। তাকে ঘিরে ভক্তদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা তুঙ্গে।
জানা যায়, ওই এলাকায় এক সময় শ্মশান ছিল। নাম ছিল চিরকুনডাঙা। বর্তমানে বড়মার মাহাত্ম্যে সেই নাম আর নেই। দু’দশক আগে ঘাটাল-চন্দ্রকোণা রাস্তার হালদারদিঘির মোড় থেকে প্রায় আধ কিলোমিটার দূরে শ্মশান এলাকায় ক্ষীরপাই শহরের বাসিন্দা শুদ্ধদেব রায়(ভানী) মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে মাটির চালায় তৈরি একটি ছোট প্রতিমার মাধ্যমে পুজোর সূচনা হয়, যা এখন ‘ছোটমা’ নামে পরিচিত। কিন্তু কেঠিয়ার জলস্ফীতির ফলে সেই মাটির চালা ও মূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে, মূর্তির একটি ভাঙা হাত ও কাঠামো মন্দির চত্বরে আজও স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রাখা আছে। পরবর্তীতে, শুদ্ধদেববাবু কংক্রিটের বিশাল মূর্তি নির্মাণ করেন এবং প্রতিষ্ঠা করেন ‘বড়মা’র মন্দির। যা রাজ্যের অন্যতম উচ্চতম কালীমূর্তি হিসেবে পরিচিত। বড়মার মন্দিরের পাশেই ছোটমার সেই স্মৃতি এতদিন পুজো হয়ে আসছে। ২০২৪ সালে বড়মার মন্দিরের পাশেই ছোটমার আলাদা মন্দির করে দেওয়া হয়েছে।
বড়মার মূর্তিটি বৃহৎ এবং অনন্য। দেবীর এক হাতে রয়েছে পৃথিবী এবং অন্য হাতে সাদা পায়রা, যা শান্তি ও ধরিত্রীর রক্ষাকর্ত্রী রূপের প্রতীক। দেবীর অপর দু’হাতে রয়েছে খড়্গ ও কাটা মুণ্ড, যা তাঁর রুদ্ররূপকে প্রকাশ করে। এই দুই বিপরীত রূপই বড়মাকে ভক্তদের মধ্যে ভক্তি ও ভয় মেশানো এক অনন্য অবস্থানে নিয়ে গিয়েছে।
ক্ষীরপাই শহরের বাসিন্দা তনুপ ঘোষ, বুলবুল ঘোষ বলেন, প্রতি অমাবস্যা তিথিতে বড়মার পুজো অনুষ্ঠিত হয়। এই বিশেষ সময়ে মন্দির প্রাঙ্গণে ভক্তদের ঢল নামে। যদিও শ্মশানকালীর পুজোয় বলি দেওয়ার প্রচলন আছে। তবে বড়মার মন্দিরে বলিদান নিষিদ্ধ। ভক্তরা পুরোহিত ছাড়াই নিজেরা মায়ের কাছে পুজো দেন। মন্দিরে কোনও টাকা বা দক্ষিণা গ্রহণ করা হয় না। কোনও প্রণামী বাক্সও নেই। মন্দিরের মূল বাণীই হল- ‘অর্থের বিনিময়ে নয়, নিজে হাতে পুজো করুন মাকে এবং ফলাফল যাচাই করুন।’ এর ফলে ভক্তদের মধ্যে এক বিশেষ আবেগ এবং মায়ের প্রতি আরও গভীর বিশ্বাসের জন্ম হয়েছে। তবে অমাবস্যা এবং কালীপুজোর সময় পুরোহিত দিয়ে পুজো হয়। এই সময় আরও ধুমধাম করে বড়মার পুজো হয়। পুজোর পরদিন কয়েক হাজার মানুষ খিচুড়ি প্রসাদ গ্রহণ করেন। প্রতিষ্ঠাতা শুদ্ধদেববাবু বলেন, প্রতি বছর পুজোর পরদিন প্রায় ১০ হাজার ভক্ত খিচুড়ি প্রসাদ গ্রহণ করেন। ছোটমার পুজোয় বলি দেওয়া হয়। সেই বলির মাংস মিশিয়ে খিচুড়ি প্রসাদ তৈরি হয়। যা ভক্তরা প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করেন। ঘাটাল ব্লকের হরিনগর হাইস্কুলের ভূগোলের শিক্ষিকা তথা ক্ষীরপাই শহরের বাসিন্দা মানসী সাহু বলেন, বড়মা শুধু একটি মূর্তি নয়। দেবী এখানে ভক্তের বিশ্বাস ও আবেগের প্রতীক। মা কালী এখানে রুদ্ররূপের পাশাপাশি শান্তি ও কল্যাণের বাহক হিসেবে বিরাজমান।