নিজস্ব প্রতিনিধি, চুঁচুড়া: দেবদেবীর পুজো মানেই নানা জনশ্রুতি আর বিশ্বাসের অমলিন সেতুবন্ধ। দেবী কালীর পুজোয় সেসব জনশ্রুতি আর বিশ্বাস একটু অদ্ভুত রকমের। একে তো দেবী ভয়ঙ্করী। সেইসঙ্গে গুহাকন্দরে, ডাকাত-তান্ত্রিকদের হাতে পূজিত হওয়া, বলিদান, এসব পুজোকে ঘিরে আছে। সময় বদলেছে। দেশকালের সঙ্গে বদলেছে হুগলি জেলা। কিন্তু গঙ্গাপাড়ের জনপদে কালীপুজোকে ঘিরে অলৌকিক আর অতিলৌকিকের বহর তাতে কমেনি। উল্টে কার্তিকের অমবস্যা তিথি এলে তা আরও জমাট হয়ে ওঠে। হুগলির কোথাও দেবী নিজের মেজাজে হুঁকো খান, কোথাও ভক্তের বুকের রক্ত নেন। ঐতিহ্যের মোড়কে দেবীর কাছে সেসব সবিনয়ে নিবেদনও করা হয়।
হুগলির শেওড়াফুলি স্টেশনের কাছেই আছে নিস্তারিণী কালীমন্দির। জনশ্রুতি তো বটেই, ভক্তদেরও বিশ্বাস মা হুঁকো খান। পুজোর দিনগুলিতে মায়ের জন্য হুঁকো সেজে দেওয়া হয়। অনেকেই সুগন্ধী তামাকের গন্ধ পেয়েছেন। দেবী নিস্তারিণীকে ঘিরে আছে আরও চমকপ্রদ জনশ্রুতি। শেওড়াফুলির রাজা হরিশ্চন্দ্র স্ত্রীদের মধ্যে বিবাদের জেরে বড় রানিকে হত্যা করেছিলেন। পরিতাপে তিনি বিবাগী হয়ে যান। সেই সময় তিনি দেবীর স্বপ্নাদেশে খুঁজে পান শিলাখণ্ড। ঘটনা ১২৩৪ বঙ্গাব্দের। তারপরেই মূর্তি নির্মাণ ও পুজো শুরু। দেবী এখানে নিস্তারদাত্রী, তাই নিস্তারিণী। রাজা হরিশ্চন্দ্র পরবর্তীতে রাজ্যের শাসনভার তাঁকেই দিয়েছিলেন। দেবী আজও শাসনদণ্ডের প্রতিরূপ হিসেবে তলোয়ার ধরে থাকেন। রাজ পরিবারের দাবি, রানি রাসমণি একবার দেবী নিস্তারিণীকে প্রণাম করতে এসেছিলেন। স্বয়ং দেবী, বালিকাবেশে তাঁকে মন্দিরের পথ দেখিয়েছিলেন।
বলাগড়ের জিরাটের অন্তর্গত কালিয়াগড় গ্রাম। সেখানে বসত করেন সুপ্রাচীন দেবী সিদ্ধেশ্বরী। এই মন্দিরস্থল দেবী সতীর বলয়োপপীঠ নামে পরিচিত। পৌরাণিক মতে, সতীর দেহত্যাগের পরে বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র তাঁর দেহ ছিন্নভিন্ন করেছিল। সেই সময় দেবীর অঙ্গ এবং অঙ্গভূষণ নানা জায়গায় খণ্ডিত হয়ে পড়ে। অঙ্গ যেখানে পড়েছিল, সেগুলি পীঠ আর অঙ্গভূষণ যেখানে পড়েছিল, সেগুলি উপপীঠ নামে পরিচিত। সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের স্থানে দেবীর হাতের বলয় পড়েছিল। তাই ওই স্থান বলয়োপপীঠ নামে পরিচিত। ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে সিদ্ধেশ্বরী মন্দির সংস্কার হয়েছিল। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের কর্তা কামাখ্যাপদ চট্টোপাধ্যায় সেই সংস্কার কাজ করেছিলেন। সেই সময়ের ফলকে মন্দিরকে ৬০০ বছরের পুরনো বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পরিবার ওই মন্দিরের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন।
হুগলির পাণ্ডুয়ার মণ্ডলাইয়ের কালীপুজোতে ভক্তের বুকের রক্ত দিতেই হয়। ওই কালী পথের কালী হিসেবেও অনেকের কাছে পরিচিত। শোনা যায়, এক তান্ত্রিকের হাতে পুজো চালু হয়েছিল। পরে তা নাগরিক সমাজকে উৎসর্গ করে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন সেই তন্ত্রসাধক।
একদা বলি হতো সেখানে। সেসব প্রথা উঠে গেলেও বিকল্প প্রথা চালু হয়নি। তাই দেবীর লোলজিহ্বাকে পরিতৃপ্ত করতে ভক্তরা বুক চিরে রক্ত খাপরায় ভরে উৎসর্গ করেন। মসৃণ খাঁড়া থেকে চুঁইয়ে পড়া রক্তে প্রতি বছর সঞ্জীবিত হয় ইতিহাস, জনশ্রুতির ধারাকথন। অমানিশার আঁধারে জোনাকির মতো জ্বলে থাকে মা শ্যামার শ্যামল ঐতিহ্য।