• চায়না লাইটের দাপটে মৃৎশিল্পীদের হাসি উধাও
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ১৮ অক্টোবর ২০২৫
  • আর দুদিন পর দীপাবলির আলোয় সেজে উঠবে সারা দেশ। আর সেই আলোর উৎসবেই পুরুলিয়ার মৃৎশিল্পীদের মন ও মেজাজ ঠিক নেই। আগে এই উৎসবে শুধুমাত্র প্রদীপের যে চাহিদা ছিল তার জোগান দিতেই হিমসিম খেতেন মৃৎশিল্পীরা। নাওয়া খাওয়া ভুলে মাটির তৈরি জিনিসপত্র তৈরিতে ব্যস্ততা দেখা যেত কুমোরপাড়ায়। সপরিবারে লেগে পড়তেন কাজে। কিন্তু বর্তমানের চিত্র ঠিক উল্টো। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগায় এখন তেমনভাবে মাটির তৈরি প্রদীপ আর সেভাবে ব্যবহার করতে চাইছে না মানুষ। কম পয়সায় রংবাহারী চায়না লাইটে বাজার ছেয়ে গিয়েছে। দেশকে আলোকিত করার কারিগররা আর আগের মতো কাজ পায় না, তাই তাঁদের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ।

    সংসার চালানো দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে মৃৎশিল্পীদের। কুমোরপাড়ায় গিয়ে দেখা গেল আর আগের মতো তাদের ব্যস্ততা নেই। তাই আলোর উৎসবে তাদের মুখে হাসিও নেই। আলোর উৎসব দীপাবলিতে সুখ সমৃদ্ধি কামনার্থে মেতে ওঠে আপামর জনতা। হাল্কা হাল্কা শীতের আমেজে একদিনের কালীপূজা ঘিরে থাকে মানুষের ব্যাপক উন্মাদনা। পুরুলিয়ার কাটিনপাড়া, কোটলুই, রঘুনাথপুর, ঝালদা, নিতুরিয়া, সাঁতুড়ি, পাড়া সহ জেলায় মাটির তৈরি সামগ্রী তৈরিতে যুক্ত রয়েছে কয়েক হাজার পরিবার। প্রদীপ সেভাবে তৈরি না হলেও কয়েকমাস আগে থেকেই জোর কদমে তৈরি হচ্ছে লক্ষ্মী-গণেশ মূর্তি। পুরুলিয়ার সদর থানার অন্তর্গত কাটিনপাড়ার মৃৎশিল্পী সুবীর কুম্ভকার বলেন, আর মাত্র হাতে গোনা তিনদিন পর কালীপুজো।

    প্রদীপ সহ ছোটদের খেলার সামগ্রী, লক্ষ্মী-গণেশ মূর্তি তৈরির কাজ চলছে এখন। মাটির জিনিসপত্র তৈরি করে পুরুলিয়ার বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করা হবে। শুধু জেলার বিভিন্ন বাজারেই নয় দীপাবলির এই সামগ্রী যাবে পড়শি রাজ্য ঝাড়খণ্ডেও বলে জানান তিনি। রঘুনাথপুরের এক মৃৎশিল্পী পরেশ কুম্ভকার বলেন, আগে মাটির প্রদীপ ও মোমবাতি জ্বালিয়ে আলোয় আলোকিত হয়ে যেত সারা এলাকা। তবে বাজারে সস্তা চাইনা লাইট আসার পর মাটির প্রদীপ বা মোমবাতির আর সেরকম কদর নেই। মাটির তৈরি প্রদীপের অস্তিত্ব এখন সঙ্কটে।

    তুলনামূলকভাবে কম পয়সায় রংবেরঙের চাইনা লাইট বাজারে সহজলভ্য হওয়ায় মাটির প্রদীপ জ্বালানো প্রায় উঠে গেছে। বেশ কয়েক বছর থেকেই চায়নার এলিডি লাইটের রোশনাইয়ে ফিকে হয়ে পড়েছে বহু প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা মাটির প্রদীপ এবং মোমবাতির আলো। নিতুরিয়ার মৃৎশিল্পী ভোলানাথ পণ্ডিত, গণেশ পণ্ডিতরা জানান, দিন দিন বাড়ছে কাঁচামালের দাম। মাটির দাম, কয়লার দাম এখন দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে কারিগরদের মজুরি ঠিকমতো উঠছে না।

    তারপর সেরকম আর বাজার নেই। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আর এই ব্যবসায় নামতেই চায় না। বাজারের করুণ অবস্থা দেখে তারা পূর্বপুরুষের এই ব্যবসা করতে নারাজ। মাটির তৈরি প্রদীপের থেকে অপেক্ষাকৃত  কম মূল্যে বেশি আলোর সম্ভার নিয়ে বাজারে হাজির চায়নার বিভিন্ন আলোকসজ্জা। তাই চাইনার লাইট খুব সহজেই নজর কাড়ে ক্রেতাদের। একে তো বাজার নেই, তারপর বাজারে জিনিসপত্র অগ্নিমূল্য। সংসার চালাতে আমরা রীতিমত হিমসিম খাচ্ছি। কী যে করব, ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছি না। মৃৎশিল্পীদের আশা আবহাওয়া যদি বাদ না সাধে তবে এবছর কিছুটা হলেও মুনাফা অর্জন করতে পারবেন তাঁরা। এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত পুরুলিয়ার শিল্পীদের মনে প্রশ্ন তাঁরা কোনওদিন কি এলইডি লাইটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারবেন? উত্তর সময়েই মিলবে।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)