কেবল ব্যবসা-বাণিজ্যেই নয়, কলকাতার উন্নয়নে অন্যতম চালিকাশক্তি হিসাবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল কালীঘাটের বিখ্যাত কালীমন্দিরের। সেই মন্দিরের তীর্থযাত্রীদের চলার পথকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল বনেদি কলকাতার হাটবাজার ও জনবসতি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই এলাকাগুলির প্রায় প্রত্যেকটির মধ্যেই প্রসিদ্ধ হয়ে উঠল এক বা অধিক কালীমন্দির। তাদের ঘিরে গড়ে ওঠা কিংবদন্তির সঙ্গে জুড়ে যেত সমসাময়িক নানা প্রসঙ্গ। যেমন কলকাতা আক্রমণের সময় বাগবাজারের ব্যোমকালী মন্দিরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার আশীর্বাদ প্রার্থনার লোকগাথা, অথবা সিদ্ধেশ্বরী কালীর পা-ধোওয়া জল পেয়েছে বলেই নাকি সে কালের বাগবাজার ঘাটের ইলিশের এত স্বাদ, এমন নানা বিষয়।
তবে কালীপুজোর সঙ্গে সম্ভবত সর্বাধিক প্রচলিত ডাকাত ও নরবলির কাহিনি। চিৎপুরের চিত্তেশ্বরী থেকে বাগবাজারের সিদ্ধেশ্বরী কালী, বা দক্ষিণের মনোহর ডাকাতের কালীবাড়ি সংক্রান্ত নানা গল্পে লুকিয়ে আছে শহরের আদিম জলা-জঙ্গলে ভরা দুর্গম অবস্থা ও ভয়ঙ্কর ডাকাতের উপদ্রবের কথা। নরবলির অনুষঙ্গে সে কালের অরাজক অবস্থার কথাও বোঝা যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ডাকাতদের যুগ-অবসান হলেও শহরের কালী-কথার আর এক পর্বে জড়িয়ে গিয়েছিল শহরের বাহুবলীদের প্রতিপত্তি প্রদর্শনের ইতিকথা।
ডাকাতদের ভয়ঙ্কর কালীপূজার সঙ্গে কৃষ্ণ-আরাধনার বিপরীত মতবাদের সমন্বয়ের ঐতিহ্যও ধরা পড়েছে কলকাতার কালীপুজোর আঙিনায়। কেওড়াতলা শ্মশানের পাশে ময়মনসিংহের আঠারোবাড়ির জমিদারদের শ্মশান-মন্দিরের পাশের গলিপথ ধরে এগোলে দেখতে পাওয়া যায় কৃষ্ণকালী মন্দিরের চতুর্ভুজ পাথরের বিগ্রহ। উপরের বাঁ হাতে খড়্গ আর ডান হাতে বরাভয় মুদ্রা, নীচের দু’টি হাতে ধরা বাঁশি। বৈষ্ণব-শাক্ত মিলনের এমনই ঝলক বাগবাজারের বিখ্যাত মদনমোহন মন্দিরেও দেখা যায় দীপান্বিতা কালীপূজায়। সে রাতে মদনমোহনকে সাজানো হয় কালীবেশে। এমনকি পরের দিন অন্নকূট উৎসবে অন্নচূড়ার উপরের নানা খাদ্য দিয়ে আঁকা হয়ে থাকে কালীর মুখ।
তবে সর্বসাধারণের জন্যে উন্মুক্ত মন্দির ও সর্বজনীন দীপান্বিতা কালীপূজার পাশাপাশি কলকাতার বহু পরিবারে আজও কৌলিক প্রথা মেনে হয়ে থাকে কালীপুজো। বাগবাজারে লক্ষ্মীনারায়ণ দত্তের বাড়িতে ১৮৮৯ সাল থেকে চলে আসছে বছরে মোট তেরো বার কালী আরাধনার প্রথা, রটন্তী কালীপূজা-সহ বারোটি অমাবস্যা মিলিয়ে। সন্ধের মুখে প্রতিমা নিয়ে আসা হয়, রাতে পুজো শেষ হওয়ার পরেই হয়ে যায় বিসর্জন। শঙ্খ ঘণ্টা কাঁসর ঢাক— কিছুই বাজানোর রীতি নেই, গোপন কৌলিক রীতি মেনে বিশেষ উপচারে সম্পন্ন হয় পূজা। এমন পূজাপদ্ধতির পাশাপাশি, কলকাতার পারিবারিক কালীপূজার পরিসরে নাগদেবী ও কালীর মিশ্রণে কল্পিত দ্বিভুজা বিগ্রহের পুজোরও চল আছে। মৃৎশিল্পীরা ‘বেদের বেটি’ নামে এই বিগ্রহ তৈরি করে দিলেও পূজক পরিবারের পরিচয় প্রকাশ করতে চান না। শক্তি-আরাধনায় এই বিচিত্র পরম্পরায় কলকাতার বহুমাত্রিক চালচিত্রটিই ফুটে ওঠে।
সেতুবন্ধ
১৯১৩ সালে নোবেল জয়ের পরে জার্মানি জুড়ে রবীন্দ্র-লেখার অনুবাদ ও প্রচার হয় ব্যাপক ভাবে। পরের বছরই গীতাঞ্জলি-র বাছাই কবিতার অনুবাদবই বেরোয়, ১৯২১-এ বেরোয় পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ। ১৯২১, ১৯২৬ ও ১৯৩০-এ জার্মানি সফরে কবিকে দেখতে বিপুল ভিড় হয়। আর ছিল হারমান হেস, রিলকে, টমাস মান, আইনস্টাইন প্রমুখের রবীন্দ্রপ্রীতি; বলতে হয় জার্মান প্রকাশক ও অনুবাদকদের কথাও। বার্লিন হামবুর্গ হাইডেলবার্গে কবির বক্তৃতা প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানিকে সম্প্রীতির উপশম দিয়েছিল। ভারত-জার্মানির সাংস্কৃতিক সেতু রবীন্দ্রনাথকে মনে রেখে ২৪ অক্টোবর সন্ধে সাড়ে ৬টায় অনুষ্ঠান করছে গ্যোয়টে ইনস্টিটিউট-ম্যাক্সমুলার ভবন, ‘রবীন্দ্রনাথ অ্যান্ড জার্মানি: আ সিম্ফনি অব কালচারস’। কোরক বসুর ভাবনা ও পরিকল্পনা, সঙ্গী ঈপ্সিতা গঙ্গোপাধ্যায় প্রদীপ দত্ত রীনাদোলন বন্দ্যোপাধ্যায় সুব্রত মুখোপাধ্যায় অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়রা। ছবিতে ১৯৩০-এ জার্মান ইয়ুথ মুভমেন্ট ক্যাম্পে রবীন্দ্রনাথ।
আজ তোমারে
বাঁ হাতে হারমোনিয়ামের রিড, দীপ্ত কণ্ঠে একের পর এক গান: ‘আজ তোমারে দেখতে এলেম’, ‘পিনাকেতে লাগে টঙ্কার’, ‘আজি ঝরঝর মুখর’, আজও মনে পড়ায় অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ‘বনে যদি ফুটল কুসুম, নেই কেন সেই পাখি’ যে স্মরণসভারও গান, তিনিই জানিয়েছিলেন। শিল্পীর ৯৬তম জন্মদিন পালনে অগ্রণী নানা সংস্থা। পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্রের সহযোগিতায় সল্টলেক ঐকতান মঞ্চে ১৫ অক্টোবর শতশিল্পী সমন্বয়ে অনুষ্ঠান সাজিয়েছিল ‘ননীগৌরীকা’, নানা সংস্থার সম্মেলক রবীন্দ্রসঙ্গীত ছিল আকর্ষণ। একই সন্ধ্যায় শিল্পীকন্যা কৌশিকী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তরুস্মৃতি’র আয়োজনে প্রিন্স গোলাম মহম্মদ শাহ রোডে ‘সেলফ অ্যান্ড বিয়ন্ড’ সভাগৃহে হল জন্মদিন পালন: সেই অপরূপ শ্রবণ ফের উদ্ভাসিত।
আত্মপ্রকাশ
অক্টোপাস তার আটটি বাহু পরস্পর নিরপেক্ষ ভাবে সঞ্চালিত করে। চিনের বিজ্ঞানী-দল তৈরি করেছেন আলো-জ্বলা উদ্ভিদ। বিজ্ঞানের বিচিত্র তথ্যকণিকা, সাম্প্রতিক খবর আমরা জানতে পারি বিজ্ঞান সংক্রান্ত ওয়েবসাইট, জার্নাল থেকে। তবে বাংলা-বাজারে বাংলা ভাষায় লেখা ও ছাপা সমৃদ্ধ বিজ্ঞান-পত্রিকা কই তত? শূন্যস্থান পূরণ করেছে নতুন পত্রিকা শূন্য: বিজ্ঞান ও পরিবেশ ভাবনা। পথিক গুহ সম্পাদিত পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদকথাও ‘শূন্য’ ঘিরে, যা আসলে ‘পূর্ণতার বীজ’। রয়েছে বিজ্ঞানের খবর, নিবন্ধ, ‘বিজ্ঞানশ্রী’ পদার্থবিদ নবকুমার মণ্ডল ও নাসা-জেপিএল’এর সিনিয়র বিজ্ঞানী গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার, কোডিং নিয়ে লেখা, মজার ‘অঙ্কজব্দ’, বিজ্ঞানগ্রন্থের আলোচনা, আরও অনেক কিছু।
ডানা মেলে
এই সময়ে, যখন প্রচলের নিয়ম মানলে তবেই মেলে স্বীকৃতি, সেখানে বাঁধ ভাঙার সাহস কেউ দেখাবে কী করে? আর যদি সত্যিই এক দিন সে-মানুষ পেয়ে যায় স্বপ্নলোকের চাবি, ভেঙে দিতে চায় স্থবির শিকলের জং-ধরা তালা, সে কি পারে তা? মানুষ চায়— নিয়মের দাসত্ব, একঘেয়েমির যন্ত্রণা, বস্তাপচা প্রাত্যহিকতার চাকা থেমে যাক, নতুন যাত্রা শুরু হোক। গোপীনাথ সামন্ত তেমনই এক মানুষ। সমাজ তাকে পাগল ঠাওরায়, কিন্তু সত্তায় সে স্বাধীন। জীবনে পার্থিব অনেক কিছু হারিয়েছে, কিন্তু যে আকাশের সন্ধান পেয়েছে তা-ই তার মুক্তি। এ নিয়েই কৌশিক চট্টোপাধ্যায় রচিত ও নির্দেশিত নাটক ডানা, সংশপ্তক নাট্যগোষ্ঠীর প্রযোজনায় অভিনীত হবে আগামী ২৪ অক্টোবর সন্ধে সাড়ে ৬টায়, জ্ঞান মঞ্চে।
১২৫ বছরে
“যুদ্ধ মানুষ চায় না একথা ঠিক কিন্তু যুদ্ধ ছাড়া মানুষের চলেও না!” দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সম্পাদকীয়, জয়শ্রী পত্রিকায়। প্রথম প্রকাশ ১৯৩১-এ, রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাণী নিয়ে: “বিজয়িনী নাই তব ভয়,/ দুঃখে ও বাধায় তব জয়।” সম্পাদক লীলা রায় (নাগ), স্বাধীনতা সংগ্রামে মেয়েদের যুক্ত করতে গড়েন ‘দীপালি ছাত্রী সঙ্ঘ’। নারীর স্বাবলম্বনে অগ্রণী ভূমিকা ছিল সঙ্ঘের, তারই মুখপত্র জয়শ্রী। সঙ্গে পেয়েছিলেন স্বামী অনিল রায়কে; কারাবরণ থেকে নেতাজির অনুগামী হিসেবে কাজ, সবেতেই। দু’জনেরই ১২৫ বছর পালন করছে ‘জয়শ্রী পত্রিকা ট্রাস্ট’। রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার, গোলপার্কের শিবানন্দ হল-এ আজ বিকেল ৫টায়, বলবেন স্বামী বলভদ্রানন্দ স্বামী সুপর্ণানন্দ তরুণ গোস্বামী বিজয় নাগ। দেখানো হবে বাংলাদেশের তথ্যচিত্র লীলাবতী।
শিল্পবই
ভিন্ন ধারার এক প্রদর্শনী, ‘দ্য গ্রে এরিয়া’। ১৫ জন ভারতীয় শিল্পীর কাজ একত্র করেছে শিল্পীগোষ্ঠী ‘অন দ্য সেম পেজ’। মূল ভাবনা ‘সংঘাত’, মাথায় রেখে শিল্পীরা তৈরি করেছেন এক-একটি শিল্পকৃতি, ‘আর্টিস্ট’স বুক’। সময় ও সমাজ হয়ে পড়ছে মেরুকরণের শিকার, তৈরি হচ্ছে নানা সংঘাত, ভাবনার স্পষ্টতাকে আবছা করে দিচ্ছে বিভেদরেখা, মুছতে চাইছে মানুষের বিশ্বাস, আকাঙ্ক্ষা, মতাদর্শ, পরিচিতির ভিন্নতা। এই বিভাজনকেই প্রশ্ন করে এই প্রদর্শনী, দেখাতে চায়— ভাবনার দুই মেরুর মাঝখানে কত বৈপরীত্য ও দ্বন্দ্ব লুকিয়ে। প্রদর্শনীর শিল্পগ্রন্থগুলি (ছবি) যেন এক-একটি শৈল্পিক আলাপচারিতা। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের নর্থ গ্যালারিতে, ১৬-২৪ অক্টোবর দেখা যাবে প্রদর্শনী, শুধু সোমবার কালীপুজোর ছুটি।
সে নাম রয়ে যাবে
উত্তর কলকাতার সিমলে পাড়া বহু কৃতী বাঙালির ঠিকানা। সবচেয়ে বিখ্যাত তো স্বামী বিবেকানন্দ, আর বলতে হয় ইংলিশ চ্যানেল জয়ী ডাক্তার বিমলচন্দ্র চন্দ্র, ও দিকে পাশাপাশি দুই বাড়িতে মান্না দে (ছবি) আর ছায়া দেবীর কথাও। “শুধু গানে নয়, কুস্তি সাঁতার ঘুড়ি ওড়ানোয় তুখোড় ছিল বাবুকাকার ভাইপো মানা, সবার ঘুড়ি কাটত,” বলতেন ছায়া দেবী। বাবুকাকা অর্থাৎ কৃষ্ণচন্দ্র দে, তাঁর ভাইপো প্রবোধ ওরফে মানা, কালক্রমে মান্না। কীর্তন ও রাগাশ্রয়ী গানে পোক্ত কণ্ঠ, সর্বভারতীয় স্তরে লঘু-সঙ্গীতচর্চাতেও স্মরণীয় নামটি: মান্না দে। তাঁর প্রয়াণের বারো বছর হয়ে গেল, এর মধ্যে তৈরি হয়েছে ‘মান্না দে সঙ্গীত অ্যাকাডেমি’। ২৪ অক্টোবর প্রয়াণদিনে বিকেল ৫টায় গ্যালারি চারুবাসনার উপেন্দ্রকিশোর সভাগৃহে ‘মান্না দে স্মৃতি বক্তৃতা’য় বক্তা গবেষক-সংগ্রাহক সপ্তর্ষি ভট্টাচার্য, থাকবেন গৌতম ঘোষ। গান, তথ্যচিত্রের প্রদর্শনও হবে সেই সঙ্গে।
স্মরণ-শ্রদ্ধা
এম এ পরীক্ষায় প্রথম ছেলেটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করুক, চেয়েছিলেন স্যর আশুতোষ। কিন্তু বিদ্যাবিক্রয়মূলক জীবিকায় বাবার নিষেধ, তাই সে চাকরি নেননি শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ। সংস্কৃত ভাষা-সাহিত্য-শাস্ত্রচর্চায় ভাটপাড়ার প্রজ্ঞা-ধারার প্রতিনিধি তিনি। নির্ভুল ভারতীয় পঞ্জিকা প্রণয়নে মেঘনাদ সাহার সভাপতিত্বে যে কমিটি গড়েন জওহরলাল নেহরু, পঞ্চানন তর্করত্নের পুত্র এই পণ্ডিতপ্রবর সেখানে ডাক পেয়েছিলেন নিজস্ব যোগ্যতায়। পরে পড়িয়েছেন কলকাতা, যাদবপুর, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে; দেশিকোত্তম, রাষ্ট্রপতি পুরস্কার, নানা উপাধি তাঁর অতুল পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতি। তাঁর স্মরণে চমৎকার একটি সংখ্যা প্রকাশ করল লেখা দিয়ে রেখাপাত পত্রিকা (সম্পা: উজ্জ্বল গোস্বামী, অতিথি সম্পা: সুলেখ ভট্টাচার্য), প্রকাশ পেল গত ১২ অক্টোবর নৈহাটির সেন্ট লুক’স ডে স্কুলের সভাকক্ষে এক অনুষ্ঠানে। মুখ্য আলোচক লোকনাথ চক্রবর্তী, ছিলেন রতনকুমার নন্দী নির্মাল্যনারায়ণ চক্রবর্তী প্রমুখ বিশিষ্টজন।