• দেব ও দেশভক্তির বন্ধন, নট্ট-নন্দীপাড়ায় শ্যামার সঙ্গে একই বেদীতে পূজিত চারণকবি মুকুন্দ দাস
    বর্তমান | ১৯ অক্টোবর ২০২৫
  • নিজস্ব প্রতিনিধি, চুঁচুড়া: সাল ১৯৫৫। হুগলির জিরাটে তৈরি হয়েছিল একটি কালীমন্দির। যে মন্দিরে দেবতার সঙ্গে স্থান পেয়েছিলেন প্রতিষ্ঠাতাদের গুরুও। সেই গুরুর নাম চারণকবি মুকুন্দ দাস। অবিভক্ত বাংলায় স্বাধীনতা আন্দোলনের আগুনে গান বেধেছিলেন তিনি। মন্দির তৈরির কালে অবশ্য প্রয়াত বাংলার চারণকবি। কিন্তু জিরাটের মন্দিরে দেবী কালীর পাশেই রয়ে গিয়েছে সাধক-কবির মূর্তি। সেই ইস্তক এক বেনজির মন্দিরে বেনজিরভাবে পুজো নেন দেবী কালী। মুকুন্দকবির শিষ্য কালীকৃষ্ণ নট্ট যখন বেঁচে ছিলেন, রক্তবস্ত্র পরিধান করে বুকের রক্ত দিয়ে পুজো দিতেন কালীকে। মন্দির তৈরির আগেই জিরাটে নট্ট-নন্দীদের বসত তৈরি হয়েছিল। জনশ্রুতি, সেই নতুন বসতিতে এসে ঘুরে গিয়েছিলেন প্রবীণ চারণকবি। এসেছিলেন আর এক ভক্ত এবং বিপ্লবী কবি নজরুল ইসলাম।

    সেসব কালের গতিকে এখন জনশ্রুতি আর ইতিহাস। ইতিহাসের শিকড়টুকুকে ধরে রেখে নট্ট-নন্দীদের মন্দিরে থিতু হয়ে আছেন শ্যামা মা আর চারণকবি, একই মন্দিরবেদীতে। যে মন্দিরের পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্বাধীনতা সংগ্রাম, উদ্বাস্তুদের যন্ত্রণা, দেশ আর দেবভক্তিগীতির এক অমলিন কথা। তাই জিরাটের নট্ট-নন্দী পাড়ার কালীপুজো শুধুই কালীপুজো নয়। 

    বর্তমান বাংলাদেশের বরিশালের মাটিতে সেইসময় আগুন জ্বলছে। তীব্র আকার নিয়েছে স্বদেশী আন্দোলন। তাতে মেতেছেন চারণকবি মুকুন্দ দাস। কালী ও দেশ মাতৃকাকেজুড়ে গান বাঁধছেন। শাক্ত আর শক্তির মেলবন্ধনে উদ্দীপ্ত করছেন প্রজন্মের পর প্রজন্মকে। সুরের আগ্নেয় মেখলায় তুফান উঠছে তাজা রক্তে। নিয়ত জ্বলছে বিপ্লবের অনির্বাণ শিখা। ছড়িয়ে পড়ছে স্বদেশভক্তির প্রবাহ। সেই জ্বালাময়ী কালে চারণকবির সহচর ছিলেন কালীকৃষ্ণ নট্ট, সতীশচন্দ্র নন্দীরা। তারপর বিভক্ত, অবিভক্ত বাংলার নদনদী দিয়ে গড়িয়েছে বিস্তর জল। স্বাধীনতার পরে পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে এপার বাংলায় চলে আসেন নট্ট-নন্দীদের অধিকাংশ সদস্য‌ই। দেশভক্তি বুকে নিয়ে দেবভক্তি আর গায়ন, বাদনে মেতে ওঠেন তাঁরা। তখনই তৈরি হয়েছিল জিরাটের নট্ট-নন্দীদের কালীমণ্ডপ। সাহায্য করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। দেশের জন্য রক্ত ঝরাতে চাওয়া মানুষগুলি দেবী কালীকে বুকের রক্তে অভিষিক্ত করতেন। রক্ত লাল পোশাকে কালীকৃষ্ণ নট্ট নিজের বুক চিরে দেবীকে রক্ত দিয়ে পুজোয় বসছেন, অনেকের স্মূতিতে সে ছবি আজও অমলিন। দীপাবলিতেই সাড়ম্বরে পুজো হয় সাবেক বিপ্লবীদের সেই দেবীর। আগে অনেক জৌলুস ছিল। এখন সেসব বিদায় নিয়েছে। তবে আচার আর নিষ্ঠার সঙ্গে রয়ে গিয়েছে পুজো। আর প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বহমান সোনাঝরা অতীতের ধারাপাত। স্বাধীনতা, দেশ ও দেবভক্তি এবং শিল্পচর্চার বিচিত্র বেণীবন্ধনের পটচিত্র। যার সাক্ষী দেবী কালী আর চারণকবির একই পক্তিতে অবস্থান।  নিজস্ব চিত্র
  • Link to this news (বর্তমান)