• আটদিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেন নির্যাতিতা ডাক্তারি পড়ুয়া
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ১৯ অক্টোবর ২০২৫
  • আটদিনের চিকিৎসার পর অবশেষে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেন দুর্গাপুরের ধর্ষণকাণ্ডে নির্যাতিতা ডাক্তারি পড়ুয়া। শুক্রবার বিকেলে তাঁকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করা হয়। তবে তিনি আপাতত নিজের হস্টেলে ফেরেননি। মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে কলেজ ক্যাম্পাসেরই একটি আলাদা ঘরে তাঁকে রাখা হয়েছে, সঙ্গে রয়েছেন তাঁর মা। ঘরের বাইরে ২৪ ঘণ্টা তাঁকে পুলিশ পাহারায় রাখা হয়েছে।

    প্রসঙ্গত, গত ১০ অক্টোবর রাতে দ্বিতীয় বর্ষের ওই মেডিক্যাল পড়ুয়াকে কলেজের বাইরে জঙ্গলে গণধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ দ্রুত তদন্তে নামে এবং মোট ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে। ধৃতদের মধ্যে পাঁচজন কলেজ লাগোয়া এলাকার যুবক, আর একজন ওই তরুণীর সহপাঠী, যাঁর সঙ্গে সেদিন তিনি কলেজের বাইরে গিয়েছিলেন। বর্তমানে সকলেই পুলিশি হেফাজতে রয়েছে।

    মেডিক্যাল কলেজের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নির্যাতিতার শারীরিক ও মানসিক অবস্থার পর্যবেক্ষণের পর চিকিৎসকরা তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছাড়ার অনুমতি দেন। তবে তাঁর নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা বজায় রাখার স্বার্থে তাঁকে কলেজ ক্যাম্পাসেরই একটি সুরক্ষিত স্থানে রাখা হয়েছে।

    নির্যাতিতার বাবার বক্তব্য, মেয়ের গোপন জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে। তিনি আগেই জানিয়েছিলেন, মেয়েকে ওড়িশায় নিয়ে যেতে চান। তবে আপাতত সেই পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে, অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ ও ফরেনসিক রিপোর্টের ভিত্তিতে তদন্ত এগোচ্ছে।

    গত সোমবার ধৃতদের ঘটনাস্থলে নিয়ে গিয়ে ঘটনার পুনর্নির্মাণ বা রেকনস্ট্রাকশন করা হয়। পুলিশ হাসপাতাল চত্বর থেকে শুরু করে পুরো রাস্তাটি ঘুরে দেখে, যেদিন নির্যাতিতা ও তাঁর সহপাঠী কলেজের বাইরে গিয়েছিলেন। ঘটনার রাতে ধৃতদের পোশাকও উদ্ধার করেছে তদন্তকারী দল।

    অন্যদিকে, অভিযুক্তদের পরিবারগুলির উপর এখন নেমে এসেছে অপমান, ভয় ও সামাজিক বয়কটের কালো ছায়া। দুর্গাপুরের বিজড়া ও মহুয়াবাগান— এই দুই গ্রাম এখন কার্যত নীরব। অধিকাংশ অভিযুক্তের পরিবার গৃহবন্দি। কেউ কথা বলতে চাইছেন না। এক অভিযুক্তের দিদি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার ভাই প্রতিদিন কাজ শেষে বাড়ি ফিরত। সেদিনও ফিরেছিল। এখন সবাই বলছে সে ধর্ষক! আমি বিশ্বাস করি না, ওকে ফাঁসানো হয়েছে।’

    আরেক অভিযুক্তের বাবার বক্তব্য, ‘যা জানার পুলিশের কাছে জানুন। আমরা আইনের উপর ভরসা রাখছি।’ তাঁর গলায় ভয়, লজ্জা ও গ্লানির ছাপ স্পষ্ট। আরেক অভিযুক্তের ভাই সংবাদমাধ্যমের দিকে সরাসরি অভিযোগ করে বলেন, ‘কিছু না জেনেই ভাইকে ধর্ষক বানিয়ে দিলেন! পুলিশের তদন্ত শেষ না হতেই কেন এমন রায়?’

    স্থানীয় এক অভিযুক্তের বাড়ি তালাবন্ধ, প্রতিবেশীরা জানালেন, পরিবারটি গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছে। কেউ জানে না, তাঁরা কোথায় গিয়েছেন। আরেক অভিযুক্তের মামা চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘বাইরে বেরোতে পারছি না। লজ্জায় সব শেষ হয়ে গেল।’

    গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও ক্ষোভ দুটোই আছে। কারও মতে, ‘প্রথমে বলা হল গণধর্ষণ, পরে বলা হচ্ছে একজনই ধর্ষক। তাহলে বাকিদের কেন গ্রেপ্তার করা হল? মোবাইল ছিনতাই আর ধর্ষণ এক নয়।’

    বিজড়া গ্রামের প্রাক্তন বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক শেখ নিজামুদ্দিন বলেন, ‘ধৃতদের মধ্যে দুইজন আমার প্রাক্তন ছাত্র। মন ভেঙে গেছে। সমাজে শুভবুদ্ধির জাগরণ হোক, এই কামনাই করি।’

    দুর্গাপুরের দুটি ঐতিহ্যপূর্ণ গ্রাম এখন কলঙ্কের ভারে নুয়ে পড়েছে। ঘটনাটি সত্যিই গণধর্ষণ ছিল, না অন্য কোনো ষড়যন্ত্র, তা এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু এই ঘটনার অভিঘাতে দুর্গাপুরের মানুষের মনে ভয়, অবিশ্বাস ও তীব্র অস্থিরতার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)