ফেডারেশন হলের ১২১ বছর, প্রদর্শিত হল স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস এবং সৌভিক মুখোপাধ্যায়ের দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহ
দৈনিক স্টেটসম্যান | ১৯ অক্টোবর ২০২৫
সময়টা ১৯০৫-এর জুলাই মাস। সরকারিভাবে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের খবর প্রকাশিত হয়েছে। সরকারি এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে হিন্দু -মুসলিম নির্বিশেষে আপামর বাঙালি। এরপর ১৩ জুলাই কৃষ্ণকুমার মিত্রের ‘সঞ্জীবনী পত্রিকা’য় ব্রিটিশবিরোধী ‘বয়কট’ -এর ডাক দেওয়া হল। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ, মতিলাল ঘোষ প্রমুখ ব্রিটিশ বিরোধী ‘বয়কট’ প্রচারের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিলেন। শহরে, মফস্বলে, জেলায় জেলায় সর্বত্র বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে হল প্রতিবাদসভা।
সুরেন্দ্রনাথের উদ্যোগে, মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর সভাপতিত্বে ৭ আগস্ট টাউন হলে হয় এক ঐতিহাসিক প্রতিবাদসভা। কলেজ স্কোয়ার থেকে ছাত্রদের শোভাযাত্রা, ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনিতে মুখরিত হল গোটা কলকাতা। প্রতিবাদ সভা থেকে স্থির হল তিনটি সভা হবে, টাউন হলের উপরে ও নীচে, বেন্টিঙ্কের মূর্তির পাদদেশে।
বিদেশি পণ্য বয়কটের পাশাপাশি বিচারালয়, স্কুল-কলেজ তথা বিদেশি শাসন বর্জনের প্রস্তাব সেদিন গৃহীত হয়। বাংলার অবিচ্ছেদ্য মিলনের প্রতীক হিসেবে একটি মিলনকেন্দ্র গড়ার প্রস্তাব উঠে টাউন হলে। সময়টা ২২ সেপ্টেম্বর। ‘ফেডারেশন হল’ নাম রাখার ভাবনা-চিন্তা করা হয়। ২৯৪ আপার সার্কুলার রোডে জমি পাওয়া যায়। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দিন ঠিক হল ১৬ অক্টোবর, ১৯০৫ (৩০ আশ্বিন ১৩১২)।
১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে রাখিবন্ধনের ডাক দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর সেই বিখ্যাত দিনেই দুই বঙ্গের মিলনকেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হল। কলকাতার গলি থেকে রাজপথ বন্দেমাতরম ধ্বনিতে মুখরিত হল। সবার হাতে রাখি। বিকেল ৩টে নাগাদ ফেডারেশন হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হল। হাজার হাজার মানুষ সেই অনুষ্ঠানে হাজির হলেন।
আনন্দমোহন বসুর লিখিত ভাষণ পড়লেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। এছাড়া ছিলেন গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় আশুতোষ চৌধুরী এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অনুষ্ঠান শেষে বাগবাজারে পশুপতি বসুর বাড়িতে ঠিক হল, দেশীয় শিল্পের লক্ষ্যে জাতীয় অর্থভাণ্ডার তৈরি হবে। সেদিন প্রায় ৭০ হাজার টাকা উঠেছিল। পুরো টাকাটাই সাধারণ মানুষের দান। ভগিনী নিবেদিতা ফেডারেশন হলের নাম দিয়েছিলেন ‘মিলন মন্দির’। বাঙালির অখণ্ডতা ও মিলনের প্রতীক এই বাড়িটি ১২১ বছরে পা রাখল। সেই উপলক্ষে ১৬ থেকে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত ফেডারেশন হলে স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর এক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ‘কলকাতা কথকতা’ নামে একটি সংস্থা এই প্রদর্শনীর আয়োজন করে।
নেতাজির হাতে লেখা চিঠি থেকে স্বাধীনতার দিন কলকাতা রাজপথ কীরকম ছিল, সেই সব ছবি প্রদর্শিত হয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের আগুন দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতে সামান্য দেশলাই বাক্স যে কী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল, তাও এই প্রদর্শনীতে দেখানো হয়। প্রতিটি দেশলাই বাক্সে স্বাধীনতাj কথা লেখা থাকত। একটি দেশলাই কোম্পানিকে তো ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধও করে। সেই দেশলাই বাক্সের উপরে লেখা ছিল ‘স্বাধীনতা সম সুখ নাই’।
দেশীয় পণ্যে ব্যবহারের ডাক সারা ফেলেছিল দেশজুড়ে। বিদেশী কোম্পানি বর্জন করে স্বনির্ভরতার পথে এগোচ্ছিল দেশ। সেই দেশীয় কোম্পানির লেভেলও এদিন প্রদর্শিত হয়। কীভাবে তাতে দেশীয় ছোঁয়া লাগে তার ধারাবাহিক ইতিহাসের গল্প বলছিলেন অরিন্দম রাউত। এছাড়া ছিলেন চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, কৌস্তুভ রাজপণ্ডিত, তাপস বসু, ফাল্গুনী দত্ত রায়, মলয় সরকার, অরূপ রায়, জয়ন্ত কুমার ঘোষ, উজ্জ্বল সর্দার, সৌভিক মুখোপাধ্যায় এবং উৎপল সান্যাল। এঁরা প্রত্যেকেই ইতিহাসের উপাদান সংগ্রাহক। প্রত্যেকের নিজস্ব সংগ্রহ এদিন অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হয়।
সৌভিক মুখোপাধ্যায় এঁদের মধ্যে একজন অন্যতম সংগ্রাহক। বাঙালি ইতিহাস বিমুখ। ইতিহাস সংরক্ষণ করতে পারে না। এই বদনামকে ভুল প্রমাণ করেছেন হাওড়া নিবাসী এই ইতিহাস সংগ্রাহক। সৌভিক মুখোপাধ্যায় ইতিহাসের একজন একনিষ্ঠ গবেষক, সংগ্রাহক। নিজের বাড়িতেই গড়ে তুলেছেন একটি সংগ্রহশালা। যা নেই মহাভারতে তা নেই ভূ-ভারতে, এই প্রবাদ বাক্যকে একার চেষ্টায় সত্যি করে তুলেছেন সৌভিক মুখোপাধ্যায়ের সংগ্রহশালা।
হাওড়ার শিবপুর ট্রাম্প ডিপোর কাছেই থাকেন সৌভিক। প্রায় আড়াইশো- তিনশো বছরের প্রাচীন বাড়ির একতলা-দোতলা নিয়ে তাঁর সংগ্রহশালা। এই বাড়িটি হল ভাষাবিদ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের জন্মভিটে। সম্পর্কে সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় সৌভিকবাবুর দাদু হন। সেখানেই গড়ে তুলেছেন এক আশ্চর্য সংগ্রহশালা। কী নেই সেখানে!
মুখোশ, পুতুল থেকে দুষ্প্রাপ্য পুস্তক, ব্রিটিশ আমলের সরকারি দলিল-দস্তাবেজ, ব্যবসায়িক লেভেল , ট্রাম-ট্রেনের টিকিট, বাঙালির মদ্যপান থেকে যৌনতা চর্চা সবই রক্ষিত হয়েছে তাঁর সংগ্রহশালায়। কিছু দুষ্প্রাপ্য ছবিও রয়েছে সৌভিক মুখোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহে। কলকাতার ট্রাম আর বাস নিয়ে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজও রয়েছে। ট্রাম আর বাসের ইতিহাস নিয়ে তিনি বহুবার প্রদর্শনীর আয়োজনও করেছেন।
ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করা তাঁর ধ্যান আর জ্ঞান। তিনি এফেমেরেল বস্তু সংগ্রহে বেশি জোর দিয়ে থাকেন। কাকে বলে এই এফেমেরা? কম সময়ের গুরুত্বপূর্ণ নথি সংগ্রহ করাকে বলে এফেমেরেল। পোস্টার, লিফলেট, টিকিট এই ধরনের জিনিস সংগ্রহ করাকে বোঝায় এফামেরেল। যা থেকে সেই সময়ের সমাজ চেতনা ও ইতিহাসের চিত্র ফুটে উঠে।
সৌভিক শুধু সংগ্রহই করেন না। কলকাতার বুকে ইতিহাস চর্চাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার জন্য তিনি বিভিন্ন প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে থাকেন। ইতিহাস চেতনা এবং ইতিহাস বোধ সাধারণ মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত করাই এখন তাঁর জীবনের ধ্যান ও জ্ঞান হয়ে উঠেছে। বাংলা তথা দেশের ইতিহাস নতুন প্রজন্ম জানাতে এবং বোঝাতে চান সৌভিক। ইতিহাস চর্চার ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সৌভিক নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।