‘বারুদের গন্ধ মনে করায়, মেয়ে মারা যায়নি, খুন হয়েছে’
আনন্দবাজার | ১৯ অক্টোবর ২০২৫
কালীপুজোর রাতের বাজি বদলে দিয়েছে গোটা সংসারটাই। খেলার ছলে সে রাতে তুবড়িতে আগুন ধরিয়েছিল পাঁচ বছরের এক শিশু। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তুবড়ি ফেটে খোলের অংশ আটকে যায় শিশুটির গলায়। রক্তাক্ত অবস্থায় দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি। সন্তান হারানো শিশুটির মা আর স্বামীর সঙ্গে থাকতে চাননি। ছেলেকে ঠাকুরমার কাছে রেখে গিয়েছিলেন মহিলা। তাঁরাই খেয়াল রাখতে পারেননি বলে আলাদা হয়ে যান তিনি। সন্তান হারিয়ে বাবাও দ্রুত কাজে যোগ দিতে পারেননি। এর পরেই শুরু হয়ে যায়লকডাউন। আর কাজে ফেরানো হয়নি পুত্রহারা সেই বাবাকে। কয়েক মাসের মধ্যেই ঘর থেকে উদ্ধার হয় তাঁর ঝুলন্ত দেহ।
একমাত্র নাতি আদি আর নিজের ছেলে কাজলকে হারানো সেই বৃদ্ধা চম্পা দাস আজও কালীপুজো এলে টিকতে পারেন না। কোনও মতে বললেন, ‘‘বায়না ধরেছিল বাজি ফাটাবে। বাচ্চার বায়না না করা যায়! বাজার থেকে ফেরার পথে আমার সঙ্গেই তুবড়ি কিনে নিয়ে ফিরেছিল। সেই বায়নার তুবড়িই যে সব শেষ করে দেবে, বুঝতে পারিনি। আমাদের সংসারটা ভেসে গিয়েছে। আজ মনে হয়, অপরাধ আমারই। ছেলের সংসারটাই শেষ হয়ে গিয়েছে।’’
বেহালার ঢালিপাড়ায় এখনও বাজি ফেটে মৃত আদির খোঁজ করলে এক বারেই চম্পার বাড়ি দেখিয়ে দেন স্থানীয়েরা। সেখানে পাড়ার কালীপুজোর মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে জোরকদমে। আলো, সাউন্ড বক্সের কমতি নেই। তার মধ্যেই যেন সব কিছুকেছাপিয়ে ভেসে ওঠে অশীতিপরের কান্না। চম্পা এখন থাকেন মেয়ে সুজাতার কাছে। সুজাতা বললেন, ‘‘দাদা আর বৌদির দেরিতে সন্তান হয়েছিল। আদিকে পেয়ে আমাদের পরিবারটাই বদলে গিয়েছিল। সারাক্ষণ আনন্দে মেতে থাকত। আমাদের এ দিকে কালীপুজোর রমরমা। এখন কালীপুজো এলে আওয়াজ অসহ্য লাগে।’’
একই দাবি কসবার বিজন সেতু লাগোয়া উত্তরপাড়া এলাকার বাসিন্দাদের অনেকের। বছর চারেক আগে কালীপুজোর রাতে তাঁদের পাড়াতেই বাজি ফাটাতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছিল বছর চল্লিশের দীপকুমার কোলের। ওই পাড়ার কালীপুজোয় দীপ যুক্ত ছিলেন। প্রতিবেশীরা জানান, প্রতিমার বরাত দেওয়া থেকে বিসর্জন, দীপকে ছাড়া পুজো ভাবা যেত না। কিন্তু যে পুজো করতেন দীপ, সেই পুজো একটি বাড়িরউঠোনে উঠে গিয়েছে। পাড়ার বাসিন্দা রেণুকা ঘোষ বলছিলেন, ‘‘সে বার পুজোর রাতেই তুবড়ি ফেটে দীপের গলায় লাগে। রক্ত এমন ভাবে বেরোতে থাকে যে, বাঁচানোর জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সুযোগটুকুও ছিল না। তার পর থেকেই পুজো ছোট করে হয়।’’
পাড়ার লোকেরা দেখিয়ে দেন, দীপদের বাড়ি। সেই বাড়ির নীচে একটি দোকানের সামনেই রাখা দীপের ছবি। পারিবারিক সেই দোকান এখন চালান দীপের দাদা তপন কোলে। তিনি বললেন, ‘‘দুর্গাপুজো শেষ হলেই বাড়ির পরিবেশ খারাপ হতে শুরু করে। কালীপুজোর রাতে একটা বাজি ফাটতে দেখলেও বুকটা কেঁপে ওঠে। ভাইয়ের মৃত্যুতে বুঝেছি, বাজি কতটা বিপজ্জনক।’’ এর পরেই তাঁর মন্তব্য, ‘‘এত জনের মৃত্যু হলেও এই মারণ আনন্দ বন্ধ হয় না। সরকারও কিছুই করে না।’’
একই রকম মন্তব্য বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে মৃত বছর ষোলোর আলো দাসের পরিবারের। মহেশতলার পুটখালি মণ্ডলপাড়ার বাজি মহল্লায় বাড়ি আলোর। তাঁদের পাশের বাড়িতেই চলত বেআইনি বাজির কারবার। এক দুপুরে ওই বাড়িতে বিস্ফোরণের জেরে তার সামনে খেলতে থাকা আলোর শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। আলোর মা কৃষ্ণা বলেন, ‘‘যার যায়, তার যায়, আদতে কিছুই বদলায় না। এখনও আমার পাড়া বাজির বারুদের উপরেই থাকে। কালীপুজো এলে বারুদের গন্ধ মনে করায়, মেয়েটা দুর্ঘটনায় মারা যায়নি, খুন হয়েছে।’’