• ২৫০ বছর আগে ভয়ংকর এই জঙ্গলে এলেন গোকুলানন্দ, চারিদিকে শিয়াল ডাকছে, প্রতিষ্ঠা হল দুর্লভাকালীর...
    ২৪ ঘন্টা | ২০ অক্টোবর ২০২৫
  • পার্থ চৌধুরী: এখনও এই মন্দিরে প্রতিদিন শিয়ালকে ভোগ দেওয়া হয়। এ প্রথার নাম-- শিবাভোগ (Shiba Bhog)। আর মন্দিরের নাম দুর্লভাকালী (Durlova Kali)। এই মন্দির ছিল শহরের একেবারে বাইরে। তখন বাইপাস বা আজকের এই এনএইচ হয়নি। নির্জন জঙ্গলে ঘেরা এই এলাকায় ডেরা বাঁধেন গোকুলানন্দ। আশেপাশে তখন শৃগাল-সহ অনেক বন্যপ্রাণী। কয়েকশো বছর আগের সেই বর্ধমান (Bardhaman) অন্যরকম ছিল। সাধক শুরু করেন এই শিবাভোগের প্রথা। আজও তাঁর বংশধরেরা এই মন্দিরে নিত্যপুজো (kalipuja 2025) করেন।  শিয়ালকে ভোগ দেন। আজকের ব্যস্ত জাতীয় সড়কে বেঘোরে চাপা পড়ে যায় সেইসব শিয়ালের বংশধরদের কেউ কেউ। তবু কিছু শিয়াল আজও বেঁচে আছে। তারাই ভোগ খেতে আসে বলে জানা গেল। যাঁদের ইতিহাস ও সাধনভজনে আগ্রহ আছে তাঁদের অনেকেই এখানে বেড়াতে আসেন।

    তিন মূর্তি

    এই মন্দিরে বছরে তিনবার পুজো হয়। এখন যে মূর্তি আছে, তার আগে আর একটি মূর্তি ছিল। তারও আগে ছিল একটি বেলকাঠের মূর্তি। সেই মূর্তি আর নেই। শুধু পাশের মন্দিরে রয়ে গিয়েছেন ভৈরব। এই মন্দিরে আসতে গেলে আজও গা ছমছম করে। রয়েছে পঞ্চমুন্ডির আসন, সাধকের স্মৃতিসৌধ। আর রয়েছে অজস্র উপকথা। যাতে জড়িয়ে আছেন বর্ধমানের রাজা তেজচন্দ্র আর গোকুলানন্দের কথা ও কাহিনি।

    লাকুড্ডির দুর্লভা কালী

    এখনও বর্ধমান জেলার  কালীমন্দিরগুলির মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত এই লাকুড্ডির দুর্লভা কালীমন্দির। তাঁকে দর্শন করা দুর্লভ ছিল বলেই এই কালীর এমন নাম। দুর্লভা কালীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা কথা ও কাহিনি। এর সঙ্গে জড়িয়ে রাজকাহিনি ও উপকথা। একদিন রাতে বর্ধমানের মহারাজ তেজচাঁদ মন্ত্রী সান্ত্রীদের নিয়ে গেলেন গোকুলানন্দ কাছে। চারদিকে ঘন জঙ্গল। তার মাঝে বসে কালী সাধনা করছেন তান্ত্রিক গোকুলানন্দ ব্রহ্মচারী। বর্ধমানের মহারাজ দেখতে চান তান্ত্রিকের অলৌকিক ক্ষমতা। 

    অমবাস্যার রাতে চাঁদ

    সেদিন ঘোর অমাবস্যা। রাজা জানতে চাইলেন, আজকের তিথি কী? তান্ত্রিক জানান, আজ পূর্ণিমা। রাজা তাঁকে পূর্ণিমার চাঁদ দেখাতে বলেন। তান্ত্রিক গোকুলানন্দ ব্রহ্মচারী বুঝতে পারেন, রাজা তাঁর ক্ষমতার পরীক্ষা নিতে এসেছেন। মৃদু হাসলেন গোকুলানন্দ। তারপর চারদিক জ্যোৎস্নায় আলোকিত হয়ে উঠল। আকাশের দিকে আঙুল দেখিয়ে তান্ত্রিক বললেন, ওই দেখুন মহারাজ, পূর্ণিমার চাঁদ (অন্য মতে বলা হয় এলাকার বাসিন্দারা মহারাজার কাছে নালিশ জানান, এখানে তান্ত্রিক মদ খেয়ে ভণ্ডামি করছেন। রাজা একদিন এক্কা গাড়ি করে হাজির হন তান্ত্রিক গোকুলানন্দের কাছে। তিনি তখন ধ্যানে মগ্ন। রাজার কথা শুনে পাশে থাকা কূপমণ্ডূক উল্টে দেন। দেখা যায় দুধ আছে)।

    বিস্মিত তেজচন্দ্র

    সেদিন বিস্মিত চোখে তন্ত্র শক্তির অদ্ভুত দৃশ্য দেখেন মহারাজ। পরবর্তীকালে মহারাজ তেজচাঁদ কালী মন্দির তৈরি করিয়ে দেন লাকুড্ডিতে। তখন থেকেই বর্ধমানের লাকুড্ডির দুর্লভা কালীবাড়িতে নিত্য পুজো হয়ে আসছে। এই কালীমন্দিরে ঘটের আবাহন বা বিসর্জন নেই। ঘট ছাড়াই শুধু বিগ্রহের পুজো হয় প্রতিদিন। মন্দির তৈরির পাশাপাশি রাজা এই মন্দিরে ভোগঘরও তৈরি করে দেন। এখন আবার নতুন করে মন্দিরের সংস্কার চলছে। তখন নাকি পুজোর ব্যয়ভার বহন করতেন রাজাই। এখন করেন গোকুলানন্দের বংশজেরা। রাজ আমলের প্রথা মেনে এখানে নিত্যপুজোর পাশাপাশি দেবীকে অন্নভোগ নিবেদন করা হয়।

    দীপান্বিতা কালীপুজোয়

    দীপান্বিতা কালীপুজোয় অগণিত ভক্তের সমাগম হয় মন্দিরে। একইভাবে বৈশাখে এবং দুর্গাপুজোর সময় দেবীর আরাধনা করা হয়। নাম নিয়েও নানা গল্প আছে। তার একটিতে মনে করা হয়, দেবীর দর্শন পাওয়া অতি দুর্লভ। তাই নাম দুর্লভা কালী। প্রায় আড়াইশো বছর আগে তান্ত্রিক গোকুলানন্দ ব্রহ্মচারী পাশের জলাশয়ে স্নান করতে নেমে একটি পাথর পান। সেই পাথরকেই মা কালী রূপে পুজো করেন তিনি। সেই পাথর খণ্ড প্রতিষ্ঠিত হয় রাজার তৈরি করে দেওয়া মন্দিরে। পরে কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হলেও আজও সেখানে সেই পাথরখণ্ড সামনে রেখেই পুজো করা হয়। এক সময়ে  সাধক কমলাকান্তও  নাকি এখানে তন্ত্র সাধনা করতে আসতেন।

    গোকুলানন্দ

    গোকুলানন্দ পরিব্রাজক ছিলেন। তিনি ঘুরতে ঘুরতে বর্ধমানের লাকুড্ডি এলাকায়  ধারে পঞ্চমুণ্ডীর আসনে বসে ধ্যান করার সময় স্বপ্নাদেশ পান। তিনি পাশের জলাশয় থেকে পাথরখণ্ড উদ্ধার করে তালপাতার ছাউনি তৈরি করে পুজো শুরু করেন। সেবাইত পরিবার  জানান, আগে এখানে ছাগ বলি হত। এখন বলি বন্ধ। শুধুমাত্র পুজোর দিন চালকুমড়ো বলি দেওয়া হয়। পুজোর দিন ভোগ বিতরণ করা হয়। আগে বসে মায়ের ভোগ খাওয়ানো হত।

  • Link to this news (২৪ ঘন্টা)