আর দেখা নেই তেনাদের…! ‘ভূত’ভীতি কাটাতে বেগুনকোদরে বিজ্ঞানমঞ্চের সদস্যরা
প্রতিদিন | ২০ অক্টোবর ২০২৫
সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: আর চলন্ত ট্রেনের সঙ্গেই সাদা শাড়ি গায়ে জড়ানো কোন অলৌকিক শক্তি ধাওয়া করে না সেই বেগুনকোদর স্টেশনে। যে মড়কের কারণে আস্ত একটা গ্রাম খালি হয়ে গিয়েছিল বাঘমুণ্ডির অযোধ্যা পাহাড়ের সেই কালহাতে। আজ সেই জনপদে অবশ্য কোন ভূতের আতঙ্ক নেই। কিন্তু এই ভূত চতুর্দশী এলেই এই বিশেষ দিনটিতে যেন এক অন্যরকম আবহ তৈরি করে পুরুলিয়ার কোটশিলার বেগুনকোদর থেকে অযোধ্যা পাহাড়ের ওই কালহা গ্রামে।
আর চলতি বছর যে পশ্চিমাঞ্চলের এই পুরুলিয়ায় নতুন করে তিনটি ভূত আতঙ্ক তৈরি হয়। চলতি বছরের এপ্রিলে হুড়ার অর্জুনজোড়ায় বাইক ধরা ভূত। তার ঠিক দেড় মাস পরে
বলরামপুরের হাড়জোড়া গ্রামে এক বছর ধরে পরপর ৯ জনের মৃত্যুতে ভূতের ভীতি। আর সেই ভয়ে ঘরছাড়া হয়ে যায় পরিবার। আর তার কিছুদিন পরেই জুনের প্রায় শেষের দিকে পুরুলিয়া-জামশেদপুর ১৮ নম্বর জাতীয় সড়কের নামশোল গ্রামে পরপর দুর্ঘটনায় আবার ভূত আতঙ্ক তৈরি হয়। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছায় যে সেখানে কালীমন্দির স্থাপনে পুলিশকে জানানো হয়। এখন অবশ্য বাইক ধরা ভূত মোটর আরোহীকে ঘাড় মটকায় না। দেয় না শরীরে আঁচড়। হাড়জোড়া গ্রামে আর নতুন করে মৃত্যু না হওয়ায় সেখানেও কোন আতঙ্ক নেই। আতঙ্ক নেই নামশোলের দুর্ঘটনাপুরেও। প্রত্যেকটিতেই একাধিক বিজ্ঞানমনস্ক সংগঠন সেখানে গিয়ে পদক্ষেপ নিয়ে ভূতের ভয় ভাঙিয়েছে। তাহলে ভূত চতুর্দশীতে কেন আবার পুরুলিয়ার দুই বিজ্ঞানমনস্ক সংগঠন ভূত, ডাইনি বা অলৌকিক কোন কিছু দেখাতে পারলে ৫৫ লাখ টাকা ইনাম ঘোষণা করল! রবিবার তাঁরা এই পুরস্কারের কথা জানায়।
আসলে এই ভূত চতুর্দশীর রাতে তেনাদেরকে সামনে রেখেই যে নানান বাণিজ্য হয়। যেখানে বাদ যায় না ঝাড়খন্ড ছুঁয়ে থাকা এই প্রান্তিক পুরুলিয়াও। একদিকে ‘ঘোস্ট ট্যুরিজম’ অন্যদিকে মাদুলি- কবজের ব্যবসা। তাই ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির পুরুলিয়া শাখা ও পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের পুরুলিয়া জেলা কমিটির তরফে যথাক্রমে ৫০ ও ৫ লাখ টাকা করে মোট ৫৫ লাখ টাকা ইনাম ঘোষণা করেছে। সেই সঙ্গে চলতি বছর এই জেলায় নতুন করে যে এলাকায় ভুতের আতঙ্ক তৈরি হয় সেই এলাকাতে দুই বিজ্ঞানমনস্ক সংগঠন নিজেদের নেটওয়ার্কে নজরদারিও চালাচ্ছে। যাতে ভূত বাণিজ্য না চলে। কুসংস্কারের থাবা না বসে। মানুষজন অযথা আতঙ্কিত হয়ে না পড়েন। বিভ্রান্ত হয়ে প্রতারিত না হন।
ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির পুরুলিয়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মধুসূদন মাহাতো বলেন, ” আমাদের ঘোষণা রয়েছে ভূত-ডাইনি বা কোন অলৌকিক কিছু দেখাতে পারলে আমরা ৫০ লাখ টাকা দেব। সেই ঘোষণা মতো ভূত চতুর্দশীর দিনেও এই বিষয়টিকে আমরা তুলে ধরেছি। ফি বছর জেলায় নতুন করে যেখানে যেখানে যেখানে ভূতের আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল আমাদের দল, প্রতিনিধি এমনকি আমি নিজে গিয়েছিলাম। কোথাও কোন ভূত পাওয়া যায়নি। সব কুসংস্কার, অপপ্রচার। তাই ভূত চতুর্দশীতেও নির্ভয়ে উৎসবের আনন্দ নিন। আমাদের বার্তা এটাই। ” একই কথা পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের পুরুলিয়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তথা চিকিৎসক নয়ন মুখোপাধ্যায়ের।
তাঁর কথায়, “বেগুনকোদর, অর্জুনজোড়ায় আমরা নিজেরা রাত জেগে মানুষের ভয় ভাঙিয়েছি। মানুষকে বিশ্বাস করিয়েছি ভূত বলে কিছু নেই। কিন্তু কিছু অসাধু মানুষজন এই ভূতচতুর্দশী এলেই আমাদের জেলায় এমন একটা আবহ তৈরি করে। সেই কারণেই আমাদের এই ইনাম ঘোষণা। আমরা বলেছি কোথাও কোনো ভূত, ডাইনি, অলৌকিক শক্তি দেখাতে পারলে আমরা ৫ লাখ টাকা পুরস্কার দেব। এই মর্মে আমরা প্রচারপত্র বিলি করে প্রচার করছি। ” ভূত চতুর্দশী তিথি যে আজ সোমবার দুপুর পর্যন্ত রয়েছে!
তাই হুড়ার অর্জুনজোড়া মোড় থেকে কেশরগড় যাওয়ার রাস্তায় ওই তেঁতুলতলায় এদিন সন্ধ্যার পর কাউকেই দেখা যায়নি। কালিপুজোর প্রাক্কালেও রাত যত বাড়তে থাকে ওই রাস্তা জনশূন্য হয়ে যায়। তাহলে কি বাইক ধরা ভূতের আতঙ্ক ভূত চতুর্দশীর দিনে? সব প্রশ্ন কার্যত এড়িয়েই যান ওই এলাকা দিয়ে যাতায়াত করা মানুষজন। একই ছবি কোটশিলার বেগুনকোদর
স্টেশনে। এদিন বিকালে এলাকার কয়েকজন যুবক, কিশোর ওই স্টেশন চত্বরে ঘোরাফেরা করলে তাদেরকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া হয় ভূত বলে তো কিছু নেই কিন্তু আতঙ্ক কি কোন রয়েছে? মুখের দিকে তাকিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে চলে যান। এই নিরুত্তরের অর্থ কি জানে না বেগুনকোদর,
জানে না অর্জুনজোড়া।
তবে বাঘমুণ্ডির অযোধ্যা পাহাড়ের কালহা গ্রামের বয়স্ক পুরুষ-মহিলা থেকে তরুণ- তরুণীরা জানেন, প্রায় ৫ দশক আগে রোগ অসুখে বাঘমুন্ডির এই গ্রামে দেখা দিয়েছিল মড়ক। একের পর এক মৃত্যুতে এমনই আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল যে ৫-৬ মাসের মধ্যেই ওই গ্রাম হয়ে গিয়েছিল জনশূন্য। এরপর বেশ কয়েক বছর পর নতুন করে জনবসতি তৈরি হলেও একটি আত্মহত্যার ঘটনায় আবার ঘরছাড়া হয়ে যায় পরিবারগুলো। কয়েক যুগ পরে আবার ওই গ্রাম সেই আগের চেহারায় ফিরে এসেছে বটে। কিন্তু অতীতের সেই কথা ভোলেনি ওই কালহা।