• বাংলায় কালী সাধনা দিনদিন নিবিড় হচ্ছে
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ২০ অক্টোবর ২০২৫
  • বাংলার কালী সাধনা অতি প্রাচীন এবং এর উৎপত্তি কয়েক হাজার বছর আগে থেকে। যদিও এর সঠিক সময় নির্ধারণ করা সম্ভব নয় তবুও নথিবদ্ধ উল্লেখ এবং পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ অনুসারে এটি দুই হাজার বছরেরও বেশি পুরানো বলা যেতে পারে। মহাভারত থেকে শুরু করে মার্কণ্ডেয় পুরাণ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থে কালীর উল্লেখ পাওয়া যায়।

    মহাভারতে কালীকে ‘কালরাত্রি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা যুদ্ধের সময় পাণ্ডবদের স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলেন। মার্কণ্ডেয় পুরাণে কালিকে দুর্গার একটি শক্তিশালী ও ক্রুদ্ধ রূপ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় আবির্ভূত হয়।।আর আধুনিক কালী মূর্তির রূপকার হিসেবে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগিশকে বিবেচনা করা হয়।

    কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ কে ছিলেন? তিনি ছিলেন সপ্তদশ শতকের নবদ্বীপের একজন বিখ্যাত তান্ত্রিক ও পণ্ডিত। তিনি নবদ্বীপের একজন কুলীন ব্রাহ্মণ এবং তন্ত্রশাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তিনি তন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে ‘বৃহদ তন্ত্রসার’ গ্রন্থটি রচনা করেন এবং এই কাজের জন্য পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর হাত ধরেই বাংলায় ঘরে ঘরে কালিপূজার প্রচলন হয়, এবং তিনি নিজেই মূর্তি তৈরি করে কালিপূজা করতেন। তবে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও রামপ্রসাদের কারণে কালিপূজা বাঙালিদের কাছে অধিক জনপ্রিয় হয়েছে।

    কৃষ্ণানন্দ ১৭০টি গ্রন্থ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ‘তন্ত্রসার’ রচনা করেন। তাঁর তৈরি করা পদ্ধতি পরবর্তীকালে রামপ্রসাদ সেন-এর মতো সাধকদের দ্বারাও অনুসৃত হয়েছিল এবং এটি আজও বাংলার ঘরে ঘরে কালীপূজার ভিত্তি স্থাপন করেছে।

    মা কালীর সৃষ্টির কথাটি বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীতে ভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে, তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যাখ্যা অনুসারে, তিনি দেবী দুর্গার উগ্র রূপ এবং তাঁর ক্রোধ থেকে জন্ম নেন। রক্তবীজ রাক্ষসের সঙ্গে যুদ্ধের সময়, দেবী দুর্গার প্রচণ্ড ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে তাঁর কপাল থেকে কালী আবির্ভূতা হন। তন্ত্র অনুসারে তিনি দশমহাবিদ্যার প্রথম দেবী। ঋগ্বেদের রাত্রিসূক্তেও কালীর উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে তাঁকে রাত্রিদেবী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

    কালী শব্দটি ‘কাল’ শব্দের স্ত্রী রূপ, যার অর্থ হলো কৃষ্ণবর্ণ। বিভিন্ন পুরাণ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মা কালী মহামায়া মা দুর্গার অন্য একটি রূপ। মা কালীর উৎপত্তির পৌরাণিক ব্যাখ্যাটি এরকম: সনাতনধর্মীয় শাস্ত্র অনুযায়ী, মা কালির আবির্ভাব সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায়, তা হলো, পুরাকালে শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামের দুই দৈত্য পৃথিবীজুড়ে তাদের ভয়ংকর ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। দেবতারাও এই দুই দৈত্যের কাছে যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে। ফলে দেবলোক তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়, তখন দেবরাজ ইন্দ্র দেবলোক ফিরে পাওয়ার জন্য আদ্যশক্তি মা মহামায়ার তপস্যা করতে থাকেন, তখন দেবী সন্তুষ্ট হয়ে তাঁদের কাছে আবির্ভূত হন। সেই দেবীই হচ্ছেন কালী।

    আরেক আখ্যানমতে, স্বর্গ তোলপাড় করে দিচ্ছে অসুরের দল। স্বর্গরাজ্য দখলের চেষ্টাও করছে তারা। দেবতাদরা আতঙ্কিত। অসুরদের প্রধান ছিল রক্তবীজ। তার ছিল ব্রহ্মার বর। যার জেরে রক্তবীজের শরীর থেকে এক ফোঁটা রক্ত ভূতলে পতিত হলেই তা থেকে জন্ম নিচ্ছিল একাধিক অসুর। এমন পরিস্থিতি থেকে স্বর্গকে রক্ষা করতে অবতীর্ণ হন দেবী দুর্গা। সব অসুর দেবী দুর্গার হাতে নিহত হল কিন্তু ব্রহ্মার রক্তবীজকে নিধন করা গেল না। তখন ক্রোধান্বিত দেবী দুর্গা তাঁর ভ্রু যুগলের মাঝ থেকে জন্ম দেন কালীকে। কালীর ভয়াবহ রুদ্রমূর্তি আর নগ্নিকা রূপে নিহত হল একের পর এক রক্তে জন্ম নেওয়া অসুরকুল। এরপর রক্তবীজকে অস্ত্রে বিদ্ধ করে তার শরীরের সব রক্ত পান করে নেন কালী। রক্তবীজের শরীর থেকে এক ফোঁটা রক্ত যাতে মাটিতে না পড়ে, সে জন্য কালী তাকে শূন্যে তুলে নেন। রক্তশূন্য করে দেহ ছুড়ে ফেলে দেন।

    মা কালী অঙ্গসজ্জা করলেন অসুরের মুণ্ড দিয়ে। বানালেন কোমরবন্ধ ও গলার মালা। কালীর উন্মাদ নৃত্যে স্বর্গে তখন ত্রাহি ত্রাহি রব। মহাদেব ছুটলেন কালীর নৃত্য বন্ধ করতে। মহাদেবের কোন কথাই শুনতে পেলেন না কালী। তখন মহাদেব বাধ্য হয়ে কালীর পায়ের তলায় নিজে পড়ে গেলেন। পায়ের নিচে স্বামীকে পড়ে থাকতে দেখে লজ্জিত হলেন কালী । লজ্জায় জিভ কাটেন তিনি। তাই নগ্ন রূপ আর অসুরদের ধড়হীন মুণ্ডর কোমরবন্ধনী ও মালার সঙ্গে সঙ্গে পায়ের তলায় শিবকে নিয়ে তিনি পূজিতা হন।।

    বাংলার কয়েকজন বিখ্যাত কালী সাধক হলেন রামপ্রসাদ সেন, রামকৃষ্ণ পরমহংস এবং কমলাকান্ত ভট্টাচার্য। এছাড়াও, বামাক্ষ্যাপা, রঘু ডাকাত এবং বাঘা যতীনের মতো আরও অনেকে ছিলেন, যারা কালী সাধনার জন্য পরিচিত। রামপ্রসাদ সেন অষ্টাদশ শতাব্দীর শাক্ত কবি ও সাধক। দেবী কালীর উদ্দেশ্যে ভক্তিগীতি রচনার জন্য পরিচিত, যা “রামপ্রসাদী” গান নামে পরিচিত।

    শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে কালীর আরাধনা করে তন্ত্র এবং অদ্বৈত বেদান্ত মতে সাধনা করেছিলেন। তিনি ছিলেন রানী রাসমণির দক্ষিনেশ্বরের পূজারী। দেবীপূজায় এই নবীন পুরোহিতের কোনও পরিমিতিবোধ ছিল না। সময়-শৃঙ্খলার ব্যাপারে নিতান্তই উদাসীন। প্রায়শই উচিত-অনুচিতের সীমা পার হয়ে যেতেন। বড়ো বিচিত্র তাঁর পূজা। সকালে ফুল তুলে, মালা গেঁথে দেবীকে সাজাতেই অনেকটা সময় চলে যেত। পূজায় বসে যথাবিধি নিজের মাথায় একটা ফুল দিয়েই হয়তো দু-ঘণ্টা ধ্যানস্থ হয়ে রইলেন কিংবা অন্ননিবেদন করে মা গ্রহণ করছেন ভেবে অনেকক্ষণ কাটিয়ে দিতেন। পরবর্তী কালে কালিসাধক ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সর্বধর্ম সমন্বয়ের বাণী ও জীব সেবাই ঈশ্বর সেবা’র বিশ্বায়ন ঘটিয়েছিলেন।

    এছাড়া কমলাকান্ত ভট্টাচার্য সাধক হিসেবে পরিচিত, যিনি কালি উপাসনা করতেন এবং তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা ও ভক্তির জন্য কিংবদন্তি সৃষ্টি করেছিলেন। সাধক বামাক্ষ্যাপার তারাপীঠের অলৌকিক কাহিনী আজও প্রচলিত আছে। এছাড়া রঘু ডাকাত এবং বাঘা যতীনের মতো বিপ্লবীরাও কালি সাধনা করতেন। আলিপুর জেলে থাকাকালীন ঋষি অরবিন্দ মা কালীর সাক্ষাৎ পান এবং তাঁর বিপ্লব জীবন আধ্যাত্মিক জীবনে পরিবর্তিত হয়।

    অস্বীকার করার উপায় নেই বাংলায় কালীপূজা অত্যন্ত জাঁকজমক ভাবেই পালিত হয়। বাড়ছে পূজার সংখ্যাও। এছাড়া সারাবছরই বাংলার কালী মায়ের প্রাঙ্গণগুলি ভক্ত সমাগমে মুখরিত। তা সে দক্ষিণেশ্বর হোক,আদ্যাপীঠ হোক, কালীঘাট হোক, সিদ্ধেশ্বরি কালীমন্দির হোক বা তারাপীঠ হোক। বাংলায় কালীসাধনা দিন দিন আরো নিবিড় হচ্ছে বললে অত্যুক্তি হবে না।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)