যিনি কালকে গ্রাস করেন তিনিই কালী। দুর্গা, জগদ্ধাত্রী প্রভৃতি কালীর বিভিন্ন রূপ। চিন্তাহরণ চক্রবর্তী তাঁর ‘হিন্দুর আচার-আচরণ’ গ্রন্থের ‘কালীপূজা’ নিবন্ধে বলেছিলেন— কালীপূজা বাঙালির একটি মন্তাড় বৈশিষ্ট। দুর্গা, কালী ও সরস্বতী এই তিন দেবীর পূজা বাঙালি বিশেষ আড়ম্বরের সঙ্গে করে থাকে। কালী বাঙালির অতি প্রিয় দেবতা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপলক্ষে বাঙালিরা এই দেবতার পূজা করে থাকে। কার্তিক মাসের অমাবস্যায় দেওয়ালির দিন যে পূজা হয় তা সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ। এর নাম দীপান্বিতা কালীপূজা। এদের মধ্যে অনেক স্থানে পাথর বা মাটির কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠিত আছে, মূর্তি তৈরি করে নানা স্থানে পূজিত হন। বহুক্ষেত্রে স্থানের নামে ইহার নাম। সাধারণের এরকম ধারণা আছে যে, ‘তন্ত্রসার’ প্রণেতা কৃষ্ণনন্দ আগামবাশীষ নাকি বঙ্গদেশে এককালীন কালীপূজার প্রবর্তক। ‘কালীতন্ত্রে’ কালীর ধ্যান— তিনি করাল বদনা, ঘোরা মুক্তকেশী, চতুর্ভূজা, মুণ্ডমালা বিভূষিতা, মহামেঘ প্রভা, শ্যামা, দিগম্বরী, ঘোর-দংস্ট্রা, পীনোন্নত পয়োধরা, শ্মশানবাসিনী, শবরূপী মহাদেবের হৃদযোপরি অবস্থিতা। তাঁর বাঁদিকের নীচের হাতে ছিন্ন নরমুণ্ড ও উপরের হাতে খড়্গ এবং ডানদিকের দু’হাতের অভয় মুদ্রা।
আজকের দিনে অবাস্তব মনে হলেও কিন্তু একসময় ফেরিওয়ালারা রাস্তায় রাস্তায় মাথায় ঝাঁকা করে থালা-বাসন-কোসন ও গৃহস্থের ব্যবহারযোগ্য, গঙ্গামাটি বিভিন্ন রকমের বেহকারির বিস্কুট, কেক প্রভৃতি ফেরি করে বেড়াতেন। তাদের মধ্যে আবার কেউ কেউ হরেক রকম চটি বই বিক্রির জন্যে নিয়ে আসতেন। ঝাপির মধ্যে থাকত লক্ষ্মী ও সত্যনারায়ণের পাঁচালি, মেয়েদের ব্রতকথা ও নিত্যকর্ম পদ্ধতি, অষ্টত্তর শ্রীকৃষ্ণের শতনাম, গোপাল ভাঁড়ের গল্প, পঞ্জিকা ইত্যাদি। এইরকম একটি বই বর্তমানে প্রবন্ধকারের নজরে পড়ে। তারই অংশ বিশেষ এখানে উদ্ধৃত করা গেল— শ্রীশ্রী কালীর অষ্টোত্তর শতনাম— শ্রী ইন্দুভূষণ ভতি বিনোদন সংগৃহীত— সর্বমঙ্গলা লাইব্রেরি ১৩৩, ক্যানিং স্ট্রিট, কলকাতা, মূল্য: এক আনা (৫ম সংস্করণ)।
‘করাল বদনা নামে প্রণাম করি। অন্তরে কামিনী নাশ নিরন্তর স্মরি।। / কালীনাম জমি সদা হৃদয় মন্দিরে, কমলা নামাতে নতি করি ভক্তি ভরে।। / কালীনামে জীব সংসারে উদ্ধার। ক্রিয়াবতী নামে হয় পুণ্যের সঞ্চার।। / কোটরক্ষী নামে দেবী প্রসন্না সতত। কামাখ্যা নামেতে হই কালীপদে নত।। / শ্রী কামসুন্দরী নামে সতত প্রচার। / কজ্জলা নামেতে নতি করি বাধবার।। / করালী নামেতে তুষ্ট কালিকা সুন্দরী। কাত্যায়নী নাম সদা হৃদিমাঝে স্মরি।। // কুঙ্গ নামে দেবীপদে করি নমস্কার। কঙ্কালা নামেতে বন্দি চরণে তাঁহার।। / স্মরিয়া করুণা নাম ডাকি কালিকারে। শ্রীকালদর্শনী নাম স্মরি বারেবারে।। / কমলা-অর্জিতা নাম জানে সর্বজন। শ্রীকাল বদনা নাম জপি অনুক্ষণ।। / জগতে প্রসিদ্ধ নাম হয় কাবেরী। কালহারা নাম স্মরি দিবা বিভাবরী।। / কেতৈুকী নামেতে করি দেবীর বন্দন। কৃষ্ণপ্রিয়া নাম করি অন্তরে স্মরণ।। / কৃষ্ণা নাম ধরে দেবী জগতে প্রচার। শ্রীকৃষ্ণা বল্লভা নামসার হৈতে সার।। / শ্রীকৃষ্ণ পূজিতা নামে তুষ্ট তিনি। একনাম হয় তাঁর শ্রীকৃষ্ণ রুপিনী।।’
কালীদেবীর নাম মাহাত্ম্যে কত স্থাননাম কত প্রসিদ্ধ লাভ করেছে তার ইয়ত্তা নেই। যথা— কালীঘাটের কালী প্রসিদ্ধ তীর্থস্থান, শ্রীরামকৃষ্ণের সাধন পীঠ দক্ষিণেশ্বর, সাধক রামপ্রসাদের হালিশহরের দক্ষিণা কালী, সাধক বামাক্ষ্যাপার তারাপীঠ প্রভৃতি। কত সঙ্গীত-সাধকের ভক্তিগীতিতে আমরা আবিষ্ট হই, বিগলিত হই, পৌঁছে যাই এক অলৌকিক ভক্তিমার্গে। আর পাঁচজন বাঙালি একত্রিত হলেই বিদেশে তাঁরা প্রথমেই গড়ে তোলেন একটি কালীমন্দির।