• বউবাজার ফিরিঙ্গি কালী মন্দিরের কথা
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ২০ অক্টোবর ২০২৫
  • কলকাতা ছাড়াও বিশ্বের নানা জায়গায় মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করে গেছেন বড় বড় সাধকরা। আর্য সভ্যতার যুগে মানুষ কালীকে দেখেছিলেন অন্ধকার রাত্রিরূপে। সূর্যপাটে যাবার পরেই সন্ধ্যে বা রাত্রি নেমে আসে তাই সূর্যের সঙ্গে রাত্রির ছিল অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক। অন্ধকার রাত্রীরূপে দেবী শক্তি হলেন কালী। যে দেবীর কাছে মানুষ শত্রুর হাত থেকে নিজেকে বাঁচার জন্য প্রার্থনা করে। মহাকাল সংহিতায় নববিধা কালীর কথা বলা হয়েছে। সেগুলি হলো আদ্যা দক্ষিণাকালী, দ্বিতীয়া ভদ্রকালী, তৃতীয়া শ্মশানকালী, চতুর্থ কালকালী, পঞ্চমী গুহ্নকালী ষষ্ঠী কামকলাকালী, সপ্তমী ধন কালিকা, অষ্টমী সিদ্ধিকালী, নবমী চণ্ডী কালিকা।

    কলকাতার কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর, আদ্যাপীঠ কলেজস্ট্রিটের ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি, বউবাজারের ফিরিঙ্গিকালী, বাগবাজারের সিদ্ধেশ্বরী কালী একেবারের সর্বজন প্রসিদ্ধ এবং মানুষের মুখে মুখে ফেরে এই মন্দিরগুলির নাম।

    বর্তমানে আমাদের কাছে যিনি অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি নামে পরিচিত ছিলেন তাঁর আসল নাম ছিল হ্যানসম্যান অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি জাতিতে তিনি ছিলেন পর্তুগিজ। কবিয়াল হিসাবেই তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

    তিনি ছিলেন মা কালীল এক পরম ভক্ত। মা কালীর প্রতি তাঁর অপরিসীম ভক্তির প্রকাশ। তাঁর লেখা বিভিন্ন পদে আমরা দেখতে পাই বহু প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত তিনি, নিজের ধর্ম ত্যাগ না করেও তিনি ধীরে ধীরে হিন্দুধর্মের দেবদেবীর প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করেন। একসময় তিনি এক হিন্দু রমণীকে বিয়ে করেন। হিন্দু রমণীর নাম ছিল সৌদামিনী। আবার কেউ কেউ বলেন, নিরুপমা রমণীটি ছিলেন বিধবা। ব্রাহ্মণের মেয়ে। এ সম্পর্কে বেশ কয়েকটি জনশ্রুতি আছে। কারও কারও মতে, তিনি ব্রাহ্মণ বিধবা রমণী। সহমরণে যেতে আপত্তি জানানোয় তিনি শেষ পর্যন্ত দাদাবউদির সংসারে আশ্রয় নেন।

    কিন্তু এক সময় দাদাবউদির অত্যাচর অসহ্য হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত এক নাপিতের বউ তাকে আশ্রয় দেন। ইতিমধ্যে অ্যান্টনির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এক সময় তা ঘনিষ্ঠতায় পৌঁছায়। অবশেষে অ্যান্টনি তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ঘরে আনেন। অ্যান্টনি ছিলেন রূপবান পুরুষ। সৌদামিনী বা নিরুপমাও ছিলেন। যথেষ্ট রূপবতী। কেউ কাউকে চিনতেন না। এক সময় অসহ্য দারিদ্র্যের জ্বালায় ওই বিধবা রমণী গলায় কলসি বেঁধে ডুবে মরার জন্যে জলে ঝাপ দেন। তখন অ্যান্টনি তাকে দেখতে পেয়ে জল থেকে উদ্ধার করেন। পরে তাদের মধ্যে প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত অ্যান্টনি সাহেব। সৌদামিনী বা নিরুপমাকে বিয়ে করে সংসারী হন। সৌদামিনী কিন্তু কিছুটা লেখাপড়া শিখেছিলেন।

    সৌদামিনীর একান্ত প্রচেষ্টায় অ্যান্টনি ধীরে ধীরে বাংলা ভাষা ও কাব্যে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেন। জনপ্রবাদ আছে, লালদিঘির সাবর্ণদের নায়েব বা ম্যানেজার ছিলেন অ্যান্টনি। এই সাবর্ণদের গৃহদেবতা ছিলেন শ্যাম রায়। প্রতিবছর এই বাড়িতে অত্যন্ত ধূমধামের সঙ্গে দোল উৎসব পালিত হত। শোনা যায়, একবার কয়েকজন সাহেব জোর করে এই উৎসব প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে চায়। অ্যান্টনি তাদের ঢুকতে। বাধা দেন। একথা জব চার্নকের কানে যেতেই তিনি অ্যান্টনিকে ডেকে পাঠান এবং চাবুক মেরে তাঁর শরীর ক্ষতবিক্ষত করেন। চাকরি থেকেও তাকে বরখাস্ত করেন। তখন অ্যান্টনি। ফরাসডাঙায় তাঁর দাদা কেলি অ্যান্টনির সঙ্গে ব্যবসা করে অর্থ উপার্জন শুরু করেন। অ্যান্টনি কবিগান করতে খুব ভালোবাসতেন। তাঁকে অনুপ্রেরণা দিতেন তাঁর স্ত্রী সৌদামিনী অর্থাৎ নিরুপমা। ভোলাময়রা ছিলেন তখনকার সেরা কবিয়াল। এই ভোলাময়রার সঙ্গে মাঝে মাঝে তাঁর কবি গানের লড়াই হত।

    ভোলাময়রা এই ফিরিঙ্গির জাতধর্ম, পোশাক নিয়ে বিদ্রুপ করতেন। কিন্তু অ্যান্টনি সে কথায় কোনও গুরুত্ব দিতেন না। শেষ পর্যন্ত এই ভোলা ময়রা অ্যান্টনির কবিত্ব শক্তিকে সম্মান জানিয়েছিলেন। সাবর্ণদের বাড়ির কাজ করার সময় তিনি শ্যাম রায় বিগ্রহ দর্শন করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করে তিনি লিখেছিলেন ‘ভজহুরে মন নন্দ নন্দন। অভয় চরণার বিন্দুরে/ দুর্লভ মানুষ জনম সৎসঙ্গ তরহ এ ভব সিন্ধুরে’। এখান থেকেই তাঁর প্রথম ভক্তিরাসের ভাব তরঙ্গের উৎপত্তি। ঠাকুর সিং, রাম বসু কিংবা ভোলা ময়রার মতো বড়ো দরের কবিয়ালদের বিদ্রুপ শুনে তিনি বিন্দুমাত্র উত্তেজিত না হয়ে, কত সহজ সরল অনায়াস ভঙ্গিতে ‘ধর্ম প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘খ্রিস্টে আর কৃষ্টে কিছু প্রভেদ নাইরে ভাই, শুধু নামের ফেরে, মানুষ ফেরে একথা তাতো শুনি নাই’।

    তখনকার সময় কিছু সমাজপতি মানুষ অ্যান্টনি এবং তার স্ত্রীর উপর নানা অত্যাচার করলেও তারা কালী মাকে ভক্তিভরে আরাধনা করে গিয়েছেন। আনুমানিক ৯৫০ বঙ্গাব্দে অ্যান্টনি, বউবাজার এলাকায় (বর্তমানে ২৪৪, বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রিট) কালীমায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এই মন্দিরই ‘ফিরিঙ্গি কালী মন্দির নামে পরিচিত। কলকাতার প্রাচীন প্রখ্যাত কালীমন্দিরগুলির মধ্যে এই মন্দির অন্যতম। এই মন্দিরে মা কালী সিদ্ধেশ্বরী মা রূপে পূজিতা।

    শুধু হিন্দু নয়, বিভিন্ন ধর্মের মানুষ এই ফিরিঙ্গি কালীবাড়িতে মাকে দর্শন করতে আসেন এবং পুজো দেন। এবং তাদের যদি কোনও কিছু পাবার আশা থাকে তবে ভক্তেরা মাকে জানিয়ে মানত করে এবং সেটির ফল লাভ করলে মাকে পূজা দিয়ে তাদের শ্রদ্ধা ও ভক্তি নিবেদন করে।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)