• ভবানী পাঠকের কালী
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ২০ অক্টোবর ২০২৫
  • শিলিগুড়ি থেকে জাতীয় সড়ক ১২ ধরে এগোলে জলপাইগুড়ি পৌঁছানো যায়। আর জাতীয় সড়ক থেকে জলপাইগুড়ি ঢোকার মুখে বাঁ দিকে রয়েছে, গাছ গাছালি ছাওয়া একটি প্রাচীন কালী মন্দির। এই জায়গাটাকে গোসালা মোড় বলা হয়। একসময় এর পাশ দিয়ে বইত তিস্তা। এখন সে নদী অনেকটাই সরে গেছে। আর কালী মন্দির, ভবনে পাঠকের কালী বলেই পরিচিত।

    আর এই ভবনী পাঠক কে জানতে হলে, প্রসেনজিৎ- শ্রাবন্তীর সিনেমার বাইরে গিয়ে উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গে যেতে হবে। মথুরাপুর-লক্ষীকান্তপুর রেলপথে বহড়ু রেল স্টেশনের পূর্বদিকে অবস্থিত ময়দা গ্রাম। দেবী কালী এখানে ময়দাকালী নামে প্রসিদ্ধ, আদপে দেবী হলেন পাতালভেদী কালী। স্টেশন থেকে মন্দিরের দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। স্টেশন থেকে রাস্তা দিয়ে বেশ খানিকটা হেঁটে গেলেই আদিগঙ্গার মজা খাত দেখতে পাওয়া যায়। ৫০০ বছর আগে এখান দিয়েই বয়ে যেত ভাগীরথী। সে সময় ময়দা ছিল এক বন্দর। এখন সবই স্মৃতি। সেই মজে যাওয়া নদীর পাড়েই বর্তমানের ময়দা গ্রাম অবস্থিত। পর্তুগিজে ‘মাদিয়া’ শব্দের অর্থ ‘বন্দর’। মনে করা হয় এই মাদিয়া শব্দ থেকেই গ্রামের ‘ময়দা’ নামের উৎপত্তি হয়েছে।

    এখানে দেবীর গর্ভমন্দিরটি মাটি থেকে বেশ কিছুটা নীচে। একটি চতুষ্কোণ গহ্বরে, বেদির ওপরে দেবীর প্রতীক স্বরূপ এটি শিলা স্থাপিত রয়েছে। শিলাটি সিঁদুরে রাঙানো। এই শিলাতেই ত্রিনয়ন বসিয়ে দক্ষিণাকালীর ধ্যানমন্ত্রে প্রত্যেকদিন নিত্য পুজো করা হয় মা কে। বলা হয়ে থাকে, শিলারূপী এই কালী স্বয়ম্ভু। পাতাল থেকে উত্থিত হয়েছেন। তাই দেবীর নাম পাতালভেদী কালী। জানা যায়, পাতালভেদী কালীর পুজোর দায়িত্বে ছিলেন পাঠক বংশ। আর এই বংশের অন্যতম পুরুষই হলেন, ভবানী পাঠক।

    তিনি স্বয়ং এই পাতালভেদী কালীর আরাধনা করতেন। এই মন্দিরের পিছনে বকুল গাছের তলায় তিনি পঞ্চমুন্ডির আসন তৈরি করেছিলেন। সেখানেই তিনি সাধনা করতেন। সেই বকুল গাছ ও পঞ্চমুন্ডির আসন আজও অবিকল রয়েছে। ভক্তরা সেই আসনের ওপরেই এখন ভবানী পাঠকের মূর্তি বসিয়েছেন। দেবীর মাহাত্ম্য নিয়ে নানান ঘটনা প্রচলিত রয়েছে। প্রচলিত বিশ্বাস মতে মনে করা হয়, দেবীর কাছে ভক্তিভরে মনের কথা বললে ইচ্ছে পূরণ হয়। লোকমুখে জানা যায়, এই মন্দিরে এসে বহু অসুস্থ মানুষের রোগমুক্তি ঘটেছে। এই মন্দিরে এসে সুস্থতা লাভ করা যায় বলে জনশ্রুতি রয়েছে। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার মন্দিরে নিত্য পুজো হয়। বিশেষ বিশেষ তিথিতে মন্দিরে বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়।

    বঙ্কিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরাণী উপন্যাসের বৈপ্লবিক চরিত্র ভবানী পাঠক। কিন্তু কাল্পনিক নয়। একদা পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ সরকার, বরেন্দ্রভূমির অত্যাচারী জমিদার, মহাজনরা তাঁর ভয়ে তটস্থ থাকতেন। কিন্তু কে এই ভবানী পাঠক ? বাংলার নানান জায়গায় তাঁর দ্বারা পূজিত কালীমূর্তির কথা আমরা লোকবিশ্বাসে জানতে পারি মাত্র। জনশ্রুতি, তিনি ছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগণা তথা সুন্দরবনের সন্তান।


    তিনি দাপিয়ে বেরিয়েছেন উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গে, সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের নায়ক তিনি। তাঁর সঙ্গেই সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র নিজের কলমের জোরে এই চরিত্রটিকে অমরত্ব দিয়ে গিয়েছেন। ব্রিটিশ সাহবেরা তাঁকে ডাকাতরাণীর গুরু বানিয়েছে, ভবানী পাঠক যাকে দলনেত্রী বানিয়েছিলেন; তিনি ইস্পাতের মেয়ে প্রফুল্ল। ডাকাতের রাণী দেবী চৌধুরাণী। ইংরেজ থেকে শুরু করে এদেশের অত্যাচারী জমিদার, দেশীয় রাজাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। গরিব, দুঃখী, অসহায় মানষের জন্যে তিনি রক্ষাকর্তীর ভূমিকায় আবতীর্ন হয়েছিলেন।

    সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র দুই চরিত্রকে পীড়িত মানুষের আশ্রয় হিসেবে তুলে ধরেছিলেন, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তারা হয়ে উঠেছিলেন জনতার ভরসা, গণ আন্দোলনের মুখ৷ তাঁরা ছিলেন দেশসেবক, আবার মা কালীর উপাসক৷ অত্যাচারী ইংরেজ, এদেশের জমিদার, রাজাদের হাত থেকে গরিবদের রক্ষা করতেন, ওদের সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন৷ শোষক-ইংরেজ তাঁদের ডাকাত হিসেবে পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরেছিল। কিন্তু তাঁরা ছিলেন ত্রাতা মধুসূদন। সন্যাসী-ফকিররাই উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এদেশে প্রথম প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিলেন৷ অবিভক্ত ভারতে উত্তরবঙ্গই ছিল তাদের লড়াইয়ের জন্মভূমি৷ ১৭৬৩-১৮০০ সালের পরে সেই আন্দোলন স্থিমিত হয়ে যায়৷

    তিস্তা নদীর তীরবর্তী দুপাশের ঘন জঙ্গল ঘেরা অঞ্চলই ছিল ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরাণীর বিচরণক্ষেত্র৷ রাজগঞ্জের শিকারপুর চা-বাগান এবং জলপাইগুড়ির গোশালা মোড়ে দেবী চৌধুরাণী ও ভবানী পাঠকের পুজো করা মা কালী রয়েছেন৷ এসব মন্দির অত্যন্ত প্রাচীন, প্রায় দু-তিন শতাব্দী এরা অতিক্রম করে ফেলেছে। জলপাইগুড়ির রাজগঞ্জের পাতলিভাসা,অঞ্চলের ‘কালীর বাড়ি’ বা ‘কালীকা বাড়ি’ এলাকায় জঙ্গলের ভেতরে গোল্টু রায় নামের এক তুঁত চাষী এক মন্দির তৈরি করেছেন। তিনি ঐ মন্দিরের নাম দিয়েছেন ‘দেবী চৌধুরাণীর নতুন মন্দির’৷ সেখানে ভবানী পাঠকের সঙ্গে দেবী চৌধুরাণীর মূর্তি বসেছে৷

    মানুষের দেবতার আসন লাভ করা আমাদের দেশে খুব একটা বিরল কিছু ঘটনা নয়৷ মানুষকে ভালোবেসে মানবপ্রেমের মধ্য দিয়ে তারা ‘মহামনবত্ব’ অর্থাৎ দেবত্ব অর্জন করে মানুষের ঈশ্বর হয়েছে৷ স্থানীয় জমিদারদের অত্যাচার যখন মাত্রা পেরিয়েছে, তখন তাঁদের ত্রাতা হয়েছেন ভবানী পাঠক,দেবী চৌধুরাণী৷ কর্মগুণে দেবতা হয়েছেন দু’জন৷ তিস্তা নদীর কূলে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরাণী সর্বাংশে রক্ত মাংসের মানুষ ছিলেন, তিস্তা নদীতে বজরা বেঁধে রেখে পাড়ের জমিতে এসে মা কালীর পুজো করতেন৷

    বঙ্কিমচন্দ্র উপন্যাস লেখার আগে সেসব মন্দির ছিল, কিছু মন্দিরের সংস্কার হয়েছে, মন্দিরগুলোর মধ্যে অধিকাংশই কালী, বিশালাক্ষী, ভবানী, ভ্রামরী দেবীর মন্দির৷ সেখানেই তারা আসতেন,দরিদ্র গ্রামবাসীদের খবর নিতেন। দেবী চৌধুরাণীর প্রকৃত পরিচয় নিয়ে নানান কিংবদন্তি শোনা যায়৷ সমগ্র উত্তরবঙ্গ জুড়েই দেবী চৌধুরাণী এবং ভবাণী পাঠক এই দুই চরিত্র মানুষ হয়েও প্রায় দেবতা হয়ে উঠেছেন৷ আদপে তাঁরা রক্ত মাংসের মানুষই৷

    ইংরেজদের নথিপত্রে ১৭৮৭ সালের জুন মাস থেকে উত্তরবঙ্গের দুই বিখ্যাত বিদ্রোহীর নাম সামনে এসেছিল, একজন ডাকাতরাণী দেবী চৌধুরাণী, আরেকজন ডাকাত সর্দার ভবানী পাঠক৷ উত্তরবঙ্গের সন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ দমনে লেফটেন্যান্ট ব্রেনানকে পাঠানো হয়েছিল৷ ইংরেজ ঐতিহাসিক গ্লেজিয়ারের অনুমান দেবী চৌধুরাণী সম্ভবত কোনও ছোট জমিদার ছিলেন, তিনি সময় মত কোম্পানির রাজস্ব দিতে না পারায় অত্যাচারিত হওয়ার ভয়ে পালিয়ে গিয়ে কৃষকদের বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন। পরে নেত্রী হয়েছেন, ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ভবানী পাঠকের সঙ্গে তিনিও রুখে দাঁড়ান৷

    ১৭৮৭ সালে কিছু ব্যবসায়ী ঢাকার কাস্টমস সুপারের কাছে অভিযোগ করেছিলেন ভবানী পাঠক তাদের নৌকা লুঠ করেছে, এমন তথ্য পাওয়া যায়৷ অভিযোগ পেয়ে সুপারিনটেনডেন্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বরকন্দাজসহ গ্রেফতারি পরোয়ানা পাঠালে ভবানী পাঠক নাকি ইংরেজদের দেশের শাসক মানতে অস্বীকার করেন এবং এক মহিলা ডাকাতের সাহায্যে নিজের লোকজন নিয়ে বনিকদের পন্যবাহী নৌকার সব ধনসম্পদ লুঠ করে নেন৷

    দেশীয় সৈন্যরা ভবানী পাঠকদের আক্রমন করতে চায় না, ওদিকে ময়মনসিংহ, বগুড়া জেলার বিরাট অংশ ইংরেজদের মানছে না, অচলাবস্থা তৈরি হচ্ছে, সেইজন্য ইংরেজ সেনাবাহিনী তৈরি হয়, ওই সৈন্যবাহিনীর সাথে পাঠকের দলের প্রবল যুদ্ধে ভবানী পাঠক এবং তাঁর দুজন ঘনিষ্ঠ সহকারীর মৃত্যু হয়৷ সেই যুদ্ধে দেবী চৌধুরাণী ছিলেন না, এরপর অত্যাচারী ব্রিটিশ ও দেশীয় রাজা, জমিদারদের ওপর দেবী চৌধুরানী আক্রমন করেছেন৷দেবী চৌধুরাণী উপন্যাসে মোঘল আমলের পরবর্তী ব্রিটিশ শাসন শুরুর সময়কাল উঠে এসেছে৷ ইংরেজ ও অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে গণসংগ্রাম, গোটা উত্তরবঙ্গ জুড়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল। আদপে এটি ছিল প্রজা বিদ্রোহ৷ অত্যাচারিত কৃষক থেকে জমিদার, সন্ন্যাসী, ফকির সবাই যোগ দিয়েছিলেন৷ অনেকের অনুমান উত্তরবঙ্গ জুড়ে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের স্রোতে যোগ দিয়েছিলেন জয়দুর্গা চৌধুরাণী৷১৭৭০-এর দুর্ভিক্ষে উত্তরবঙ্গ খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। গোটা বাংলার তিন ভাগের এক ভাগ মানুষ মারা গিয়েছিলেন৷ বিস্তীর্ণ জনপদ পরিণত হয়েছে শ্মশানে, রংপুরের দেবী সিংহের রাজস্বের তবু ছাড় নেই৷

    প্রজাদের রাজস্ব পরিশোধের জুলুমের বিরুদ্ধে জয়দুর্গা চোধুরাণীর পরামর্শে দেবী সিংহরের কাছে প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলেন শিবচন্দ্র রায়৷ তারপর তিনি বন্দি হলে দেবী সিংহকে ঘুষ দিয়ে তিনি মুক্তি লাভ করেন৷ এরপর শিবচন্দ্র রায় রংপুরের সব প্রজাকে জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হতে ইটাকুমারীতে আমন্ত্রন জানান, অনেকে এসেছিলেন কিন্তু গর্জে উঠেছিলেন একজন তিনি নারী, জয়দুর্গা চৌধুরাণী৷

    জয়দুর্গা চৌধুরাণীর জ্বালাময়ী কথায় উত্তেজিত জনতা দলবদ্ধ ভাবে দেবী সিংহের বাড়ি আক্রমন করে, সে পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে বাঁচে ৷ পরে এই দেবী সিংহই মুর্শিদাবাদে আশ্রয় নেন। সমকালীন ঘটনা বিশ্লেষণ করে মনে হয় দুজনেই এক মানুষ। সরকারি নথিতে গ্লেজিয়ার ‘রংপুর ডিষ্ট্রিক্ট রিপোর্ট’ -এ দেবী চৌধুরাণী ও ভবানী পাঠকের নাম নথিভুক্ত করেছেন । ভবানী পাঠককে বাজপুরের অধিবাসী বলেছেন। বাজপুর আবার রংপুর জেলায় অবস্থিত৷ একই সঙ্গে দেবী চৌধুরাণীকে তিনি ক্ষুদ্র মহিলা জমিদার বলেছেন,পরে অত্যাচারিত হয়ে মহিলা ডাকাত হিসেবে পরিচিত হন৷

    তখন ব্রেনান সাহেব রংপুরের জেলা কালেক্টরের থেকে দেবী চৌধুরাণীকে বন্দি করার অনুমতি চাইলেন৷ দেবী চৌধুরাণী কোনওদিন ইংরেজের হাতে বন্দি হননি। তাঁর নাম আর কোনও সরকারি নথিপত্রে পাওয়া যায় না৷ দেবী চৌধুরাণী, ভবানী পাঠক ছিলেন সাধারণ মানুষের ত্রাতা, তাদের অন্নদাতা, রক্ষাকর্তা, তাদের ভগবান৷ সেই কারণে দেবতার সঙ্গে তাদের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে৷ জলপাইগুড়ির গোল্টু রায় ‘দেবী চৌধুরাণীর নতুন মন্দির’ তৈরি করেছেন৷ তার দাবি তিনি মা কালীর স্বপ্নাদেশে দেবী চৌধুরাণীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন৷ বাংলার জোতদার এবং ইংরেজ সৈন্যদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে গরিব মানুষদের কাছে দেবতার আসনে বসেছিলেন দেবী চৌধুরাণী এবং ভবানী পাঠক৷
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)