• নির্মাণ করে প্রণামী দিলেই নকশা পাশ
    আনন্দবাজার | ২০ অক্টোবর ২০২৫
  • ‘‘বাঁ দিকের বাড়িগুলো অত উঁচু না হলে পরিষ্কার দেখতে পেতেন কাঞ্চনজঙ্ঘা।’’ আক্ষেপ করছেন গাড়ির চালক। হিলকার্ট রোড ধরে পাহাড়ে উঠছে গাড়ি। জোড়বাংলো মোড় পেরিয়ে গন্তব্য দার্জিলিং। আর একটু এগোতেই পাহাড়ের ঢাল ক্রমশই কংক্রিটের জঙ্গলে ঢাকছে। চালক ফের বললেন, ‘‘এই বাড়িগুলোর জন্যই না ধস নামে!’’

    হিমাচলে সাম্প্রতিক হড়পা বানে নতুন করে সামনে এসেছে বঙ্গে পাহাড়ে বেআইনি ভাবে নির্মাণের প্রসঙ্গ। অভিযোগ, রাজ্য পুর-আইন মেনে ১১.৩ মিটারের বেশি উঁচু ভবন পাহাড়ে নির্মাণের সম্মতি নেই। অথচ, পাহাড় জুড়ে ১৩-১৪ মিটার বা তার বেশি উঁচু ভবন নির্মাণ চলছে। কী করে হচ্ছে? কান পাতলেই শোনা যায়, মাটি পরীক্ষা হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নকশা পাশ করে ভবন নির্মাণ হয় না। নির্মাণ শেষ করার পরে ‘যথাস্থানে প্রণামী’ দিলেই নকশা পাশ।

    কার্শিয়াংয়ের রোহিণীর রাস্তা সাম্প্রতিক দুর্যোগে এ বার অনেকটা জায়গা জুড়ে ধসে গিয়েছে। রোহিণী গেট থেকে শুরু করে হিলকার্ট রোড ধরে যত দার্জিলিঙের দিকে যাওয়া যায়, ততই দেখা যায়, বাঁ দিকে একের পরে এক নতুন নির্মাণ হয়েছে। হচ্ছে। কোথাও গাড়ি বা মোটরবাইকের শো-রুম, কোথাও হোম-স্টে, কোথাও রেস্তরাঁ। তেমন এক নির্মাণের মালিক বললেন, ‘‘পর্যটকেরা এখন এমন জায়গায় থাকা পছন্দ করছেন। তাই স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে নিয়ে হোম-স্টে করি। অনুমতি পেতে একটু ধরাধরি করতে হয়েছে, আর কী!’’

    সম্প্রতি একটি মামলার প্রেক্ষিতে দার্জিলিং পুরসভাকে ৪০টি ভবনের অবৈধ অংশ ভাঙতে বলা হয়েছে দাবি করে দার্জিলিঙের একাধিক বাসিন্দা বলেন, ‘‘সব অবৈধ নির্মাণ ভাঙতে হলে কত ভাঙতে হবে তারহিসেব নেই।’’

    পরিস্থিতি নিয়ে সরব হয়েছেন ‘গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রশন’ (জিটিএ)-এর প্রাক্তন প্রধান বিনয় তামাং, অজয় এডওয়ার্ডের মতো নেতারা। বিনয় বলেন, ‘‘শুধু কি ভবন নির্মাণ? পাহাড়ের উন্নয়নে যে সমস্ত প্রকল্পের টাকা আসছে, তার কতটা কাজে ব্যবহার হচ্ছে?’’ পাহাড়ে প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার রাস্তা-সহ বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে র মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ‘রুরাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফান্ড’ (আরআইডিএফ)-এ রাস্তা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ভবন তৈরি-সহ যে সব পরিকাঠামো গড়া হয়েছে সে সবের ‘ইউটিলাইজ়েশন সার্টিফিকেট’ পর্যন্ত দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ। অজয় বলেন, ‘‘রাজ্য এবং কেন্দ্র চায়, পাহাড়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের দুর্নীতির সুযোগ দিয়ে তাঁদের হাতের পুতুল করে রাখতে।’’

    যদিও অজয়ের হামরো পার্টি যখন দার্জিলিং পুরসভায় ক্ষমতায় ছিল, তারা নীতি কার্যকর করায় কতটা সক্রিয় ছিল, সে প্রশ্ন রয়েছে পাহাড়বাসীর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাঁদের একাংশের অভিজ্ঞতা, হামরো পার্টিতে থাকাকালীন যে সব পুরপ্রতিনিধিদের সাধারণ জীবনযাপন করতে দেখা যেত, দল বদলে অনীত থাপার প্রজাতান্ত্রিক মোর্চায় যাওয়ার পরে, তাঁদের একাংশকে বিলাসবহুল বড় গাড়িতে চেপে সঙ্গীদের নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। সব অভিযোগ উড়িয়ে প্রজাতান্ত্রিক মোর্চার নেতা তথা জিটিএ-র মুখপাত্র শক্তি শর্মা বলেন, ‘‘পর্যটক বাড়ছে। পাহাড়ে পরিকাঠামো গড়তে জায়গার অভাব। কোথাও কিছু করতে গেলে দেখা যায় সেটা চা বাগান, বন দফতরের জায়গা। তাই কোনটা বৈধ, কোনটা অবৈধ—টানাপড়েন চলছে।’’

    আঙুল উঠছে প্রশাসনের দিকেও। গত ৪ অক্টোবর ধস, জলস্রোতে মিরিকের পর্যটন মানচিত্রে উঠে আসা তাবাকোশি গ্রামটি কার্যত পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে। ৩৭টি হোম-স্টে নষ্ট হয়েছে। প্রশাসনের আধিকারিকদের একাংশ জানান, চা বাগানের জমিতে, নদীর ধারে কোনও নীতি না মেনে সে সব গড়ে উঠেছিল। কে অনুমতি দিল? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হোম-স্টে মালিকের কথায়, ‘‘সবাই সব জানে। কিন্তু কিছু তো করতে হবে। এতে বাসিন্দাদের এবং এলাকার আর্থসামাজিক উন্নয়ন হচ্ছিল।’’ প্রশাসনের এক কর্তার কথায়, ‘‘টাকা দিলে, এখানে সব হয়।’’

    পাহাড়ের বর্তমান পরিস্থিতির পিছনে কোটি কোটি টাকার খেলা চলছে বলে অভিযোগ জন আন্দোলন পার্টির নেতা হরকাবাহাদুর ছেত্রীর। গাড়ির চালক বলছিলেন, ‘‘রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনের কিছু আধিকারিক, ঠিকাদার—সকলেই টাকা কামাতে ব্যস্ত। পাহাড়ের হাল নিয়ে ওঁরা ভাবেন না।’’
  • Link to this news (আনন্দবাজার)