প্রবীণেরা বলে থাকেন, যত্র আয়, তত্র ব্যয়ের সংসারে সঞ্চয় হয় না। তাই মাপমতো কাপড় কাটার আপ্তবাক্যটি মনে করিয়ে দেন তাঁরা। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নামক বৃহত্তর পরিবারটিরও খরচ আয়ের চেয়ে বেশি। সরকারি স্তরে বলা হয়, কল্যাণকর রাষ্ট্র কোনও কিছু এড়িয়ে যেতে পারে না। কিন্তু আয়-ব্যয়ের বৈষম্য থাকলে সে কাজ দীর্ঘস্থায়ী হবে কি না, সে প্রশ্নথেকে যায়।
সরকারের আয় নির্ভর করে নিজস্ব রাজস্ব বা কর সংগ্রহ, কেন্দ্রীয় সরকারের আদায় করা করের ভাগ, কেন্দ্রের অনুদান এবং বিভিন্ন ধরনের ঋণের উপরে। তা দিয়ে দফতরগুলির মাধ্যমে জনগণের উপযোগী বিভিন্ন কাজ, বেতন, পেনশন, সরকারি প্রশাসনিক খরচখরচা চালানো, আর্থিক অনুদান, ধার শোধ ইত্যাদি করতে হয়। আর্থিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, এই সব কাজ করে হাতে টাকা থাকলে, মানুষের স্বার্থে অতিরিক্ত কোনও কাজ শুরু করা যায় দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যে। কিন্তু গত বেশ কয়েক বছর ধরে রাজ্যের রাজস্ব বাড়লেও, নিজস্ব আয়ের উৎস ক্রমশ কমেছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে খরচের বহর। অনেক খরচ কাটছাঁট করতে হচ্ছে সরকারকে। প্রশাসনিক সূত্র জানাচ্ছে, দফতরগুলিকে এখন বাজেট বরাদ্দ পেতেই বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে। বলে দেওয়া হচ্ছে, একমাত্র সেই খরচই হোক, যেগুলি একেবারে না হলেই নয়।
সরকারের এই আর্থিক টান বোঝা যায়, প্রধানত ধার শোধ করার চাপ, রাজস্ব ঘাটতি এবং রাজকোষ ঘাটতি দেখে। সরকারি তথ্যে, গত কয়েক বছরে বেড়েছে রাজস্ব এবং রাজকোষ ঘাটতি। বাড়ছে ধার শোধের পরিমাণও।
কী ভাবে বাড়ছে খরচ? মহিলা উপভোক্তাদের জন্য চালু লক্ষ্মীর ভান্ডারে বিপুল বরাদ্দ রাখতে হচ্ছে। সরকারের দাবি, নারী ক্ষমতায়নের স্বার্থে চালু হয়েছে এই প্রকল্প। মানুষের হাতে টাকা পৌঁছলে চাহিদা, ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে, সচল হয় অর্থনীতি। পশ্চিমবঙ্গের অনুকরণে বেশ কিছু রাজ্য এমন প্রকল্প চালু করেছে। কিন্তু বিরোধীদের বক্তব্য, একমাত্র আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষদের জন্য প্রকল্পটি যুক্তিযুক্ত। ধনী-দরিদ্র সকলের জন্য প্রকল্প উন্মুক্ত করা অযৌক্তিক। ফলে এটা শাসকদলের মহিলা-ভোটব্যাঙ্ক ধরে রাখার কৌশল মাত্র। যদিও অর্থনীতিবিদদের একাংশের মতে, মধ্যবিত্ত পরিবারেও অনেক ক্ষেত্রেই বাড়ির মহিলাদের হাতে নিজস্ব আয় বলে কিছু থাকে না। সে ক্ষেত্রে এই টাকা নিজস্ব আয় বলেই মনে করেন বহু মহিলা। সেই প্রকল্পে গত বছর ১৪,৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। এ বছর তা বেড়ে হয়েছে ২৬,৭০০ কোটি টাকা। আগামী ভোটের আগে এই প্রকল্পের মাথাপিছু অনুদান বাড়ানো হবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। তা হলে আরও বোঝা বাড়বে সরকারের উপরে।
বিভিন্ন অভিযোগে কেন্দ্র আবাস প্রকল্পের অনুদান বন্ধ রাখায়, গত লোকসভা ভোটের আগে নিজেদের খরচে প্রায় ১২ লক্ষ মানুষকে বাড়ি দিতে সরকারকে বরাদ্দ করতে হয়েছিল ১৫,৪৫৬ কোটি টাকা। আগামী বিধানসভা ভোটের আগে আরও প্রায় ১৬ লক্ষ মানুষকে এই টাকা দেওয়ার ঘোষণায় সরকারের খরচ হবে প্রায় ১৯,২০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া রয়েছে পুজো অনুদান বাবদ প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বাড়তি খরচ। রয়েছে, স্বাস্থ্যসাথী, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, পড়ুয়াদের ট্যাব-স্মার্টফোন-সাইকেল দেওয়া, কৃষকবন্ধু, পড়ুয়া ঋণ কার্ড ইত্যাদি খরচও। ভোট মাথায় রেখে ‘আমাদের পাড়া, আমাদের সমাধান’ কর্মসূচিতে আট হাজার কোটি টাকা খরচের ঘোষণা হয়েছে।
কিন্তু টাকা আসবে কোথা থেকে? কৃষকবন্ধু, স্বাস্থ্যসাথী, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, সাইকেল দেওয়ার খাতে বরাদ্দ এ বছর কমাতে হয়েছে রাজ্যকে। পূর্ত বা পুর ও নগরোন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতরের বরাদ্দ বেড়েছে নামেমাত্র (যথাক্রমে ২০ এবং ৪০ কোটি টাকা করে)। ক্ষুদ্র-ছোট ও মাঝারি শিল্প দফতরের বরাদ্দ বরং কমেছে আগের বছরের থেকে। নানা প্রান্তে রাস্তার পরিস্থিতি বেহাল হলেও, তাপ্পি দেওয়া ছাড়া বড় সংস্কারের কাজ প্রায় হচ্ছে না বললেই চলে। কারণ, বরাদ্দ থাকলেও, তুলনায় কম অর্থ হাতে পাচ্ছেওই দফতর।
তবে উপায়? আর্থিক বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্যান্য রাজ্যের মতো নিজস্ব আয় বাড়ানোর চেষ্টা করা জরুরি। অতিরিক্ত কর বসাতে না চাওয়ায় নিজস্ব আয় বাড়ানোর রাস্তাও সংকীর্ণ। পুরসভা-পঞ্চায়েতগুলি পুরোপুরি স্বাবলম্বী হওয়ার বদলে সরকারের দেওয়া অর্থের উপরেই নির্ভরশীল। তাতে ধাক্কা খাচ্ছে পরিষেবা। নিজস্ব আয়ের রাস্তা সঙ্কুচিত হওয়ায় কেন্দ্রীয় বরাদ্দ এবং ধারের উপর নির্ভরতা ক্রমশ বাড়ছে। সরকারি দাবি— জিএসটি কমায় অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা লোকসান হবে। ঘটনাচক্রে, কোভিড পরিস্থিতির মতো সম্প্রতি বিপর্যয় মোকাবিলায় ত্রাণ তহবিল চালু করে সাধারণের থেকে অনুদান চাইছে রাজ্য। আবার টোটো নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে নথিভুক্তিকরণের মাধ্যমে অর্থ বেঁধে দিয়েছে পরিবহণ দফতর। একে টাকা জোগাড়ের চেষ্টা হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিজেপি বিধায়ক তথা অর্থনীতিবিদ অশোক লাহিড়ীর বক্তব্য, ‘‘সরকার এবং পরিবারের বাজেটে খুব মিল রয়েছে। খরচের প্রশ্নে অগ্রাধিকার এবং দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য থাকা উচিত। না হলে ধারের বহর বাড়ে। তৈরি হয় ঋণের জাল।’’ যদিও রাজ্য সরকারের যুক্তি, কেন্দ্র তাদের বিপুল বকেয়া (প্রায় ১ লক্ষ ৭২ হাজার কোটি টাকা) আটকে রাখার কারণে অযথা সঙ্কট তৈরি হয়েছে। বহু প্রকল্পে বরাদ্দ বন্ধ (এই তালিকায় আছে আবাস, একশো দিনের কাজ, জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন, গ্রামীণ সড়ক, গ্রামীণ জলের মতো প্রকল্প)। ফলে রাজ্যকেই সেগুলির পুরো দায় সামলাতে হচ্ছে। বেশির ভাগ প্রকল্পে কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে বরাদ্দের ভাগ যথাক্রমে ৬০ এবং ৪০ শতাংশ। এখন রাজ্যকে একশো ভাগই সামলাতে হচ্ছে। ফলে আয় যা থাকুক, ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। অর্থ দফতরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘রাজ্য সরকার তার দায়িত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। আয় বাড়ানোর উৎস-সন্ধান রাজ্যই করবে। তবে কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে আমরা মানুষের পাশে থাকতে বদ্ধপরিকর। কেন্দ্রের তীব্র বঞ্চনা তা ঠেকাতে পারছে কি!’’