• আলোর উৎসবেও ম্লান নাগরাকাটা, নমো নমো করেই কালীপুজো সারছেন বিধ্বস্ত বাসিন্দারা
    প্রতিদিন | ২১ অক্টোবর ২০২৫
  • অরূপ বসাক, মালবাজার: প্রবল বর্ষণ এবং ভুটান থেকে ধেয়ে আসা জলে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকা। ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয় মালবাজার মহকুমার নাগরাকাটা এলাকায়। শুধুমাত্র এই ব্লকেই মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে ১২ জনের। বহু ঘরবাড়ি ভেঙে পড়েছে। স্কুল, রাস্তাঘাট, দোকানপাট—সবকিছু ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এই পরিস্থিতিতে উৎসব নয়, বরং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতেই একযোগে মানবিক সিদ্ধান্ত নিল নাগরাকাটার পুজো কমিটিগুলি। এলাকার সমস্ত পুজো উদ্যোক্তাদের একটাই কথা, এই বছর কালীপুজো হবে নমো নমো করেই।

    ধীরে ধীরে ছন্দে ফিরেছে পাহাড়। নতুন করে পর্যটকরাও পাহাড়মুখী হতে শুরু করেছেন। কিন্তু সেই রাতের কথা আজও ভুলতে পারছেন না নাগরাকাটাবাসী। শুধু তাই নয়, মনে পড়লেই একেবারে শিউরে উঠছেন সেখানকার মানুষ। স্থানীয় মানুষজনের কথায়, ”অতিবৃষ্টির জেরে পাহাড়ি নদীগুলির জল বেড়ে প্লাবিত হয় নাগরাকাটা ও আশপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। হু হু করে বাড়তে থাকা জল, একের পর এক এলাকা ডুবে যাওয়া, মানুষের মৃত্যু- সমস্ত কিছু যেন এক দুঃস্বপ্ন।” স্থানীয়দের দাবি, ঘটনার রেশ এখনও রয়ে গিয়েছে। এখনও অনেক পরিবার রাত কাটাচ্ছে স্কুল কিংবা আশ্রয়কেন্দ্রগুলিতে। কেউ কেউ আবার ঠাঁই নিয়েছেন আত্মীয়ের বাড়িতে।

    যদিও প্রশাসনের তরফে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পুনর্বাসন এবং পুনর্গঠনের কাজ করা হচ্ছে। কিন্তু আলোর উৎসবে এখনও ‘আতঙ্ক’ কাটেনি সেখানকার মানুষজনের। আর তাই দীপাবলি এবং কালীপুজোর সময়েও কোনও উৎসবের আমেজ নেই নাগরাকাটায়। এলাকার অন্যতম পুরনো ও জনপ্রিয় পুজো লুকসান কালচারাল অ্যান্ড স্পোর্টিং ক্লাব। এই ক্লাবের কালীপুজো দেখতে প্রতিবছর ভিড় জমে। কিন্তু এবছর ভিড় নয়, রয়েছে শুধুই স্তব্ধতা। ক্লাবের সভাপতি জার্মান ছেত্রী বলেন, ”এমন ভয়াবহ দৃশ্য এর আগে দেখিনি। মানুষের চোখে শুধু কান্না। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, মায়ের সামনে প্রার্থনা করব— এই দুর্দিন যেন আর না আসে। আর তাই এই বছর কালীপুজো হবে একদম নামমাত্র।”

    নাগরাকাটার স্কুলপাড়া এলাকা ছিল বন্যার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলির একটি। এখানকার পুজো কমিটির সম্পাদক ইন্দ্রনীল রায়ের নিজের বাড়িও জলমগ্ন হয়েছিল। তিনি বলেন, ” ঘটনার দিন আমার নিজের বাড়িতেও কোমর সমান জল ঢুকেছিল। আমাদের পুজো কমিটি ঠিক করেছে, এবছর শুধুই প্রতীকী পুজো হবে। ঢাক বাজবে, কিন্তু কোনও মাইক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আতসবাজি—কিছুই হবে না। সমস্ত অর্থ দুর্গতদের সাহায্যেই ব্যয় করা হবে।”

    নাগরাকাটা থানা আবাসিক পুজো এলাকাবাসীর অন্যতম আকর্ষণ। প্রতিবছর থানা প্রাঙ্গণে জমকালো আয়োজন হয়। তবে এবছর শুধুমাত্র থানার মন্দিরে পুজো হবে। পুজো কমিটির তরফে জানানো হয়েছে, প্রথা রক্ষার জন্য পুজো করা হবে, কিন্তু কোনও আনুষ্ঠানিকতা, আলোকসজ্জা বা আমন্ত্রিত অতিথি থাকছে না। একই ছবি দেখা গিয়েছে নাগরাকাটার আরেকটি বড় পুজো সুভাষ কালচারাল অ্যান্ড স্পোর্টিং ক্লাবের পুজোতেও। এই পুজো কমিটির সম্পাদক উৎপল রায় বলেন, ”আমরা এই বছর মাইক বাজাব না, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হবে না। সেই অর্থ আমরা ত্রাণের কাজে লাগাচ্ছি। আমাদের পুজোর একমাত্র উদ্দেশ্য এবার, মানুষের পাশে থাকা।”

    পুজো মানে উৎসব, আনন্দ, রঙিন আলো। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে নাগরাকাটার প্রতিটি পুজো কমিটির কাছেই এবারের কালীপুজো শুধুই শোকের উৎসব! যেখানে মা কালীকে আহ্বান জানানো হচ্ছে জীবনের রক্ষা ও ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য।
  • Link to this news (প্রতিদিন)