• ‘হেরো’ সূচকে কাটা যাবে কি জয়ী বিধায়কদের নামও? ব্লক সভাপতি পদে রদবদলের পরে জল্পনা শুরু তৃণমূলের অন্দরে
    আনন্দবাজার | ২০ অক্টোবর ২০২৫
  • ঘোষণা হয়েছিল ২০২৪ সালের ২১ জুলাই। তার পর নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে তা বাস্তবায়িত হয়েছে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে। বিষয়: তৃণমূলের ব্লক সভাপতি বদল। কয়েকটি জেলা বাদ দিয়ে সারা রাজ্যে সেই সাংগঠনিক রদবদলে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীতিই কার্যকর হয়েছে। অর্থাৎ, লোকসভায় যেখানে তৃণমূল জিতেছে, সেখানকার ব্লক সভাপতি পদে বহাল রয়েছেন। যেখানে তৃণমূল পিছিয়ে, সেখানকার ব্লক সভাপতিকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

    এই ‘হেরো’ সূচক কি বহাল থাকবে বিধানসভা ভোটে প্রার্থী চয়নের ক্ষেত্রেও? গত কয়েক দিন ধরে এই আলোচনা চলছে তৃণমূলের অন্দরে।

    তৃণমূল সূত্রের খবর, সম্প্রতি অভিষেকও ঘনিষ্ঠবৃত্তের আলোচনায় খানিকটা শ্লাঘা নিয়েই বলেছেন, তাঁর নীতি তিনি বাস্তবায়িত করেছেন। যিনি দলকে নিজের এলাকায় লোকসভায় জিতিয়েছেন, তিনি কোনও বড় নেতার অপছন্দের হলেও পদে বহাল রয়েছেন। আবার যাঁর এলাকায় লোকসভায় দল জিততে পারেনি, তিনি কোনও বড় নেতার ‘কাছের লোক’ হলেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বহু জায়গায় ‘এক ব্যক্তি-এক পদ’ নীতিও কার্যকর করা হয়েছে বলে দাবি অভিষেক-ঘনিষ্ঠদের। এর পরেই শাসকদলের অন্দরে এই মর্মে কৌতূহল তৈরি হয়েছে যে, বিধানসভা ভোটের টিকিট বণ্টনে সূচক কী হবে?

    যে লোকসভা আসনে তৃণমূল হেরেছে, সেখানে এমন অনেক বিধানসভা রয়েছে, যেখানে তৃণমূল ২০২১ সালে জিতেছিল। কিন্তু লোকসভার ফলাফলের নিরিখে দেখা যাচ্ছে পিছিয়ে আছে তৃণমূল। যেমন রায়গঞ্জ লোকসভার অন্তর্গত করণদিঘিতে তৃণমূল জিতেছিল গত বিধানসভায়। কিন্তু লোকসভায় সেই বিধানসভায় ২১ হাজার ভোটে পিছিয়ে জোড়াফুল শিবির।

    আবার এমন উদাহরণও রয়েছে, যেখানে লোকসভা আসন তৃণমূল পুনরুদ্ধার করেছে। কিন্তু ‘দাপুটে’ বিধায়কের এলাকায় দলের প্রার্থী পিছিয়ে আছেন। যেমন হুগলি লোকসভা বিজেপির থেকে পুনরুদ্ধার করেছে তৃণমূল। সেই হুগলির অধীনে রয়েছে সপ্তগ্রাম বিধানসভা। যেখানকার বিধায়ক প্রবীণ তৃণমূল নেতা তপন দাশগুপ্ত। তপন মাঝে এক বার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারে প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন। ছিলেন জেলা সভাপতিও। তাঁর কেন্দ্রেই গত লোকসভা ভোটে তৃণমূলের রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় পিছিয়ে ছিলেন দু’হাজার ভোটে। আবার হুগলি লোকসভার অন্তর্গত বলাগড় বিধানসভায় পিছিয়ে তৃণমূল। বলাগড়ের বিধায়ক মনোরঞ্জন ব্যাপারীকে নিয়ে নানাবিধ গুঞ্জন রয়েছে। ফের তাঁকে প্রার্থী করা হোক, চান না জেলা নেতৃত্বের বড় অংশ। কিন্তু পিছিয়ে থাকার কারণে কি কাটা যাবে তপনের মতো দীর্ঘ দিনের নেতার নামও?

    গত কয়েক বছর ধরেই তৃণমূলে প্রার্থিতালিকা তৈরির নেপথ্যে পরামর্শদাতা সংস্থার মুখ্য ভূমিকা থাকে। তাদের সমীক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাতে ফলও পেয়েছে তৃণমূল। তবে সবটাই তারা করে না। শেষ পর্যন্ত দলের সর্বময় নেত্রী হিসাবে মমতাই সিলমোহর দেন। কিন্তু সংগঠনের রদবদলে যে ভাবে জেতা-হারাকে ‘সূচক’ করা হয়েছে, তাতে পিছিয়ে থাকা অনেক এলাকার জেতা বিধায়ক এবং তাঁর অনুগামীদের মধ্যেও খানিক সংশয় তৈরি হয়েছে।

    শুধু তা-ই নয়। তৃণমূলের অনেক ওজনদার মন্ত্রী মনে করছেন, বিধানসভায় জেতা জায়গায় লোকসভায় পিছিয়ে পড়ার নেপথ্যে স্থানীয় স্তরের প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা কাজ করেছে। কোথাও কোথাও অন্তর্ঘাত হয়েছে বলেও অনুমান তাঁদের। উত্তরবঙ্গের এক মন্ত্রী যেমন আশঙ্কাপ্রকাশ করছেন যে, ‘‘স্থানীয় স্তরের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা সামাল দিতে প্রার্থী বদল পুরনো পন্থা। কিন্তু এ বার সেই পুরনো পন্থাই নতুন মোড়কে বাস্তবায়িত হতে পারে। সেই মোড়ক হবে জেতা-হারার সূচক।’’ তবে তৃণমূল সূত্রে খবর, প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে শুধু একটি সূচকই দেখা হবে না। জেতা বিধায়কের বয়স, শেষ পাঁচ বছরের সক্রিয়তা, বিধানসভায় হাজিরা, আলোচনায় অংশগ্রহণ করা— ইত্যাদি নানা সূচকও দেখা হবে।

    ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে বিজেপি জিতেছিল ৭৭টি আসন। তার পরে উপনির্বাচনে বেশ কিছু আসন খোয়াতে হয় পদ্মশিবিরকে। কয়েক জন বিধায়ক আবার যোগ দেন তৃণমূলে। সব মিলিয়ে এখন পদ্মশিবিরে রয়েছেন ৬৫ জন বিধায়ক। সেই বিজেপি-ই আবার গত লোকসভা ভোটের ফলাফলের নিরিখে ৯২টি বিধানসভায় এগিয়ে রয়েছে। যে বাম-কংগ্রেস বিধানসভায় শূন্য, তারাও ১২টি বিধানসভায় এগিয়ে। এর মধ্যে ১০টিতে এগিয়ে কংগ্রেস। মুর্শিদাবাদের লালগোলা এবং রানিনগর বিধানসভা কেন্দ্রে এগিয়ে সিপিএম। ২০২১ সালের সঙ্গে ২০২৪ সালের ফলাফলের তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে গোটা ৩০ আসনে তৃণমূল পিছিয়ে পড়েছে। তৃণমূলের প্রথম সারির অনেকের বক্তব্য, হারা আসন পুনরুদ্ধারের জন্য নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারে দল। কিন্তু জেতা আসনের সূচক কী হবে? ব্লক সভাপতি রদবদলের সূত্রে সেটাই এখন শাসকদলের অন্দরে অন্যতম আলোচ্য।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)