• দীপাবলি তো এখন দিওয়ালি হয়ে গিয়েছে আর কালীপুজো তো প্রায় হারিয়েই যাচ্ছে: ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়
    আজকাল | ২০ অক্টোবর ২০২৫
  • দুর্গা, লক্ষ্মীর পরেই আসেন দেবী কালী। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে কালী পূজিতা হন দীপান্বিতা রূপে। আঁধার থেকে আলোয় উত্তরণের উদ্‌যাপন। সারা রাত জেগে তাঁর পুজো, ভোগ রান্না, নৈবেদ্য সাজানো—সব কিছু নিষ্ঠা আর সমর্পণের কথাই বলে। কালীপুজো মানেই চারিদিক আলোয় ভরিয়ে তোলার সময়। এ বছর একই দিনে দীপাবলি-ও। তা কালীপুজো এখন ঠিক কেমন ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়ের কাছে? আজকাল ডট ইন-এর কাছে মন খুলে সেকথাই বললেন অভিনেতা।

    “দীপাবলি তো এখন দিওয়ালি হয়ে গিয়েছে! আমার বেড়ে ওঠা আটের দশকে। ছোটবেলায় আমরা কালীপুজো বলতাম। দীপাবলি অথবা দিওয়ালি কোনওটাই বলতাম না। তখন আমাদের প্রধান মজা ছিল, সব তুতো ভাইবোনেরা একসঙ্গে হয়ে বাজি ফাটাব কতক্ষণে। এবং অবশ্যই বাড়ির বড়দের ত্বত্তাবধানে। অত শব্দবাজির তো তখন আমদানি হয়নি, হ্যাঁ চকোলেট বোম ফাটাত কেউ কেউ আর মূলত ফুলঝুরি, রংমশাল, তুবড়ি, তারাবাজি-ই থাকত আমাদের ঝুলিতে। আর হ্যাঁ, কার বাবা কত টাকার বাজি কিনে নিয়ে এসেছে, তা ভাবাটা সুদূর কল্পনাতেও আসত না আমাদের! যেই প্রতিযোগিতাটা এখন একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই চারপাশে দেখতে পাওয়া যায়।

    আর একটা জিনিস যেটা ছিল নির্বিঘ্নে রাস্তায় হেঁটে কিংবা বড়জোর ট্যাক্সি চেপে কালীপুজোর মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরতে যেতে পারতাম। পূর্ণ সিনেমার ঠিক উল্টোদিকে একটা বিরাট কালীপুজো হয় আজও, সেখানে যেতাম। যেতাম হরিশ পার্কের বিখ্যাত কালীপুজো দেখতে। চামুণ্ডা কালী! কী ভিড় যে হত, বাপরে বাপ! তবু একটা শৃঙ্খল ছিল। অদ্ভুত সুন্দর একটা লাইট অ্যান্ড সাউন্ড অনুষ্ঠান হত। এই বিষয়টি মনে হয় এখন কেউ আর জানেও না। দেবী মূর্তির পাশাপাশি ডাকিনী-যোগিনীর নানান ভয়ঙ্কর অবতারের মাটির মূর্তি তৈরি করা হত, তার উপর ওরকম আলো-আঁধারি...গা ছমছম করত। চেতলায় যেতাম। এখানে একটা কথা যোগ করা ভীষণ দরকরি। আমাদের ওই সময়টায় কিন্তু কুকুর বিড়ালের লেজে বা গায়ে বাজি ফাটানোর মতো অসভ্যতামিগুলো হত না, যা এখন আকছার হচ্ছে!

    আমাদের ছোটবেলায় ধনতেরাস বলে এখানে কিচ্ছু ছিল না। জানতামই না। গত ১৩-১৪ বছর ধরে দেখছি ধনতেরাসের বাড়াবাড়ি। আর এর পিছনে কারণ আছে। কলকাতায় এখন বাঙালিদের থেকে অবাঙালিদের আধিক্য বেশি। আমাদের শহরে বাঙালির সংখ্যা কমছে। আর এই অবাঙালিদের মধ্যে বেশিরভাগ বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা, গুজরাট...ফলে তাঁদের প্রভাব বেড়েছে বঙ্গে। তার উপর তাঁদের হাতে প্রচুর অর্থ। বছর কয়েক আগে হাওড়া গিয়েছিলাম একটি কালীপুজোর মণ্ডপ উদ্বোধনে। সেখানকার বাঙালি কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, হাওড়াতে এখন বাঙালিরা-ই সংখ্যালঘু! ভাবা যায়!

    একটু খেয়াল করে দেখবেন অন্য কোনও রাজ্যে কালীপুজো হয় না, দীপাবলির সময় লক্ষ্মী-গণেশের পুজো করেন সেসব রাজ্যের অধিবাসীরা। কালীপুজো এই সময়টায় মহাসমারোহে পালন করা হয় বাংলাতেই। আর এখন আমাদের সেই সংস্কৃতিই যেন ব্যাকফুটে চলে গিয়েছে। আর এই বাংলাতেই কালীপুজোর শুভেচ্ছা আর কেউ প্রায় বলেনই না, সবাই শুভ দীপাবলি নয়তো হ্যাপি দিওয়ালি! দেবী কালীর যে এত রূপ, সে কথা এখনকার প্রজন্ম জানে? না জানতে আগ্রহী? সবাই ধনতেরাস, দিওয়ালি উদযাপনে, দেখতে ব্যস্ত। তাই খারাপ লাগে একজন বাঙালি হিসেবে, শিল্পী হিসেবে এইসব দেখতে অসম্ভব খারাপ লাগে। আমার ঐতিহ্য, কৃষ্টি হারিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে, তা দেখে খারাপ লাগবে না? অন্য সংস্কৃতিকে আপন করে নিচ্ছে , তা নিক সেটায় অসুবিধে নেই। কিন্তু নিজেদের শিকড় ভুলবে কেন? এখন আলপনার বদলে দেওয়া হয় রঙ্গোলি, লাইটিং গেট নেই বদলে রকমারি কীসব! আসলে, পুরোটাই হয়ে গিয়েছে চাকচিক্য, প্যাকেজ, প্রতিযোগিতা। আমাকে দেখুন ব্যাপার আর কী! সে বাজি হোক কিংবা ধনতেরাস! আমার কাছে এখন পুরো এই দীপাবলিটাই এককথায় শো-অফ....আর কালীপুজো? সে তো প্রায় হারিয়েই যাচ্ছে।”
  • Link to this news (আজকাল)