• ঋণের চাপে কি ধাক্কা আর্থিক শ্রীবৃদ্ধিতে, প্রশ্ন বিশেষজ্ঞদের
    আনন্দবাজার | ২১ অক্টোবর ২০২৫
  • কথায় বলে, ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ। কিন্তু বাস্তবে ধার নিয়ে ঘি খেলে তার ফল কি সব সময় ভাল হয়? টানাটানির সংসারে ধার করলে তার ইএমআই-এর চাপ কতটা, তা মধ্যবিত্ত ভালই জানে। আর সাধ্যের বাইরে ধার করলে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়তে হয় পরিবারকে। তেমন আয়ের প্রায় সব উৎস সীমিত হয়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত খরচ সামলাতে বাড়তি ধার করতে হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকেও। ধার শোধে গুণতে হচ্ছে গুচ্ছ অর্থ।

    আর্থিক বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, পরিস্থিতি এমন, শীঘ্রই গড় মাথাপিছু ধার ছাপিয়ে যেতে পারে ৭২ হাজার টাকা। অর্থাৎ, এই সময়ে কোনও শিশু ভূমিষ্ঠ হলে সে-ও ঢুকে পড়বে এই বৃত্তে। যদিও সরকারি তরফের দাবি, অর্থনীতি রয়েছে সঠিক পথে। অতিক্রম করতে হচ্ছে না ধারের সীমা।

    রাজ্যের বাজেট তথ্য অনুযায়ী, এ বছর মোট ধারের পরিমাণ হতে পারে প্রায় ৭ লক্ষ ৭১ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। ২০২৬ সালে রাজ্যের জনসংখ্যা ১০.৬২ কোটি হতে পারে বলে সরকারি সূত্রের অনুমান। ফলে এই জনসংখ্যার মধ্যে মোট ধার ভাগ করে দিলে এক এক জনের গড় মাথাপিছু ঋণের বোঝা ৭২ হাজার টাকা পার হয়ে যেতে পারে। ২০১০-১১ সালে এ রাজ্যে জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৯.১২ কোটি। তখন গড় মাথাপিছু ধারের বোঝা ছিল প্রায় ২০,৫০০ টাকা। অর্থ-কর্তাদের একাংশের মতে, মাথাপিছু রাজস্ব বা আয়ের তুলনায় মাথাপিছু ধারের পরিমাণও একই রকম বেশি।

    অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করেন, উন্নয়নশীল অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আয়ের তুলনায় ব্যয় কিছুটা বেশি হলে লোকসান নেই। তাতেও ধার করতে হয়। তবে সেই খরচ প্রধানত হতে হয় সড়ক-সেতু-বন্দরের মতো স্থায়ী সম্পদ তৈরিতে। যাতে দীর্ঘমেয়াদে সেগুলিকে কেন্দ্র করে বাড়ে আর্থিক কর্মকাণ্ড এবং রাজ্যের নিজস্ব আয়ও। অর্থনীতির ভাষায় রাজস্ব এবং মূলধনী খরচ করে রাজ্য সরকার। মূলধনী খরচে প্রধানত এমন স্থায়ী সম্পদ তৈরি হওয়ার কথা। রাজস্ব খরচ হওয়ার কথা সামাজিক প্রকল্প, বেতন-পেনশন, দফতরের বরাদ্দ, অনুদান প্রকল্প-সহ বাকি কাজকর্মে।

    কিন্তু সরকারি তথ্য বলছে, গত কয়েক বছরে রাজ্যের মোট ধারের পরিমাণ ক্রমশ বেড়েছে, সমান্তরালে বেড়েছে ঋণ শোধের পরিমাণও। আবার ধার করার সব পথের মধ্যে বাজার থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা খুব বেশি। অথচ এর সুদের হার তুলনায় চড়া। এই অবস্থায় অভিজ্ঞ আধিকারিকদের মতে, মূলধনী খরচের বেশিরভাগই বেরিয়ে যাচ্ছে ধার শোধ করতে। ফলে স্থায়ী সম্পদ তৈরির সুযোগ কমছে। টাকার টান বাড়ছে। এতে নতুন কাজ হাতে নেওয়ার সুযোগও কমছে। ফলে, সামগ্রিক ভাবে সরকারের ঋণের বোঝা বাড়লেও মানুষের কর্মসংস্থান সে ভাবে বাড়ছে না। তার ফলে আরও ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও প্রবল। যা অর্থনীতির কুখ্যাত বিষচক্রের মতো।

    বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই জাল কাটতে না পারলে সমূহ বিপদের আশঙ্কা থেকে যায়। যদিও রাজ্য এ ক্ষেত্রেও ‘কেন্দ্রের বঞ্চনা’র যুক্তি দেখিয়ে বলেছে, কেন্দ্র লক্ষাধিক কোটি টাকা আটকে না রাখলে রাজ্যকে তুলনায় অনেক কম ধার করতে হত।

    এ বছরের বাজেটেই রাজ্য জানিয়েছিল, গত বছর অতিরিক্ত প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছিল। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি খরচ ছিল সামাজিক-অনুদান খাতে। ধার শোধ করতেই কিছু অতিরিক্ত খরচ করতে হয়েছিল। যদিও ২০২৩-২৪ সালে অতিরিক্ত খরচ হয়েছিল ১৫ হাজার কোটি টাকার মতো। আবার, গত বছরের সংশোধিত হিসাবে রাজ্যের নিজস্ব আয় ছিল প্রায় ১.০৩ লক্ষ কোটি টাকা। অথচ তখন ধার শোধের পরিমাণই ছিল ৭৭ হাজার ২২৮ কোটি টাকা।

    এই অবস্থায় আবাস, আমাদের পাড়া আমাদের সমাধানের মতো বিপুল খরচসাপেক্ষ অতিরিক্ত প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে ভোটের আগে। এর পরে রাজ্য সরকারকে বকেয়া ডিএ যদি দিতে হয়, তবে বোঝা আরও বাড়বে সন্দেহ নেই। তবে কি ধার আরও বাড়তে পারে?

    রাজ্যের অভ্যন্তরীণ গড় উৎপাদনের (জিএসডিপি) সঙ্গে ধারের অনুপাত দেখলে এই প্রবণতা আরও স্পষ্ট হয়। গত কয়েক বছরে এই অনুপাত ক্রমশ বেড়েছে। জিএসডিপির সঙ্গে রাজস্ব এবং রাজকোষ ঘাটতিও বেড়েছে একই ভাবে। তবে রাজ্য সরকারের অন্দরের বক্তব্য, ২০১০-১১ সালে ধার ছিল জিএসডিপি-র ৪১.৯%। তৃণমূল সরকারের আমলেই তা কমেছে। আবার অন্য আরও একাধিক রাজ্য এমন বিপুল ঋণ করছে। দেশের ঋণের বহরও বিপুল ভাবে বেড়েছে। ফলে শুধুমাত্র এ রাজ্যের বিষয়টি আলাদা করে দেখা অনুচিত। যদিও এ রাজ্যের প্রবণতা দেখে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক কয়েক বছর আগেই জানিয়েছিল, ২০২৬-২৭ সালে এই হার ৩৭%-এ পৌঁছে যাবে। রাজ্যের অনুমান, তা হতে পারে প্রায় ৩৮%।

    অর্থনীতিবিদ তথা বিজেপি বিধায়ক অশোক লাহিড়ীর মতে, “মূলধনী খরচ দিয়ে স্থায়ী সম্পদ তৈরি না হলে আর্থিক অগ্রগতি আটকে যায়।”

    অর্থ দফতরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, “আর্থিক শৃঙ্খলা মেনে রাজ্য পদক্ষেপ করছে বলেই, আমাদের ধার করার সীমা বেড়েছে। তবু রাজ্য কখনও সেই সীমা ছাড়ায়নি। বরং সীমার তুলনায় অনেক কম ধার করে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে।” ঋণের জাল সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য, “রাজ্য সরকার জানে, অর্থনৈতিক দিক থেকে কী ভাবে সুরক্ষিত থাকতে হয়। ফলে সে ভাবেই পদক্ষেপ করা হচ্ছে। ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ার বিষয় নেই।”
  • Link to this news (আনন্দবাজার)