• হাতে মায়ের পায়ের জবা আর কানে স্বর্ণযুগের গান, ভক্তিতে মাতোয়ারা বারাসত
    বর্তমান | ২২ অক্টোবর ২০২৫
  • নিজস্ব প্রতিনিধি, বারাসত: কতশত রঙের আলো। মানুষের ভিড়। প্যান্ডেলে অগণিত দর্শনার্থী। নস্টালজিক করে তোলা পুরনো দিনের চিরনতুন কোনও গান। ‘ওল্ড ইজ গোল্ড’ বলে মুখে হাসি যুবকের। ঠিক তখন মান্না’র ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’-শুনে বৃদ্ধা তাকালেন হাত ধরে থাকা বৃদ্ধের দিকে। দু’জনে বেরিয়েছেন ঠাকুর দেখতে। ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’-শুনে তরুণীর চোখ আচমকা ছলছল। স্কুল জীবনের প্রথম প্রেম চাগিয়ে উঠে ভিজিয়ে দিয়েছে চোখ। ধূপের গন্ধে, ধুনোর ধোঁয়ায় সে জল আরও গাঢ়। তবে মন খারাপ লহমায় দুরও করে দিল কালী। ধোঁয়ার মধ্যে আবছা তাঁর চোখ। তা অকাতরে বরাভয় দিয়ে গেল অগণিত ভক্তকে। রাত হঠাৎই হয়ে উঠল আরও মোহময়। মিষ্টি রাতে হাত ধরাধরি করে ঘুরল বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া, তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী। হেঁটে হেঁটে মেয়ের পায়ে ব্যথা। কোলে নিলেন বাবা। ছেলেকে নিয়ে বসলেন মা। দু’টো আইশক্রিমের অর্ডার হল। আর সব গান সবার হয়ে বেজে চলল গোটা রাত। ভোর পর্যন্ত আনন্দে উদ্বেল বারাসত।

    রাজু আর সুপ্রিয়া হেসে ফেললেন। বললেন, ‘যে বছর আমরা দু’জন প্রথম কালীপুজোয় একসঙ্গে বেরিয়েছিলাম সে দিন এই গানটাই বাজছিল-তুমি আসবে বলে তাই...। কালীপুজোয় শুনে মনে হল সময় হঠাৎ যেন থেমে গিয়েছে।’ মঙ্গলবার ঘড়ির কাঁটা যখন জানাচ্ছে, দুপুর সাড়ে ১২টা। ছাতা মাথায় টাকি রোডের ধারে শতদল ক্লাবের সামনে তখন দাঁড়িয়ে তরুণ-তরুণী। মাইকে শোনা যাচ্ছে, ‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম...’ গানের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে দু’জন। বললেন, ‘এটা আমাদের জন্যই। গানের কথাগুলো আমরা মনে গেঁথে রেখে দিয়েছি।’ শুধু দর্শক নয় উদ্যোক্তারাও বুঝেছেন স্বর্ণযুগের গানগুলির আবেদন। তাই অধিকাংশ মণ্ডপে মান্না, লতা, আশা, হেমন্ত, রাহুল দেব বর্মন, সন্ধ্যা, গীতা দত্ত, কিশোর, শ্যামলেরই গান শুধু। আধুনিক আলোকসজ্জার সঙ্গে পুরনো প্রেমের কথা আর পছন্দের গানে বারাসতের রাত উজ্জ্বল। রাস্তায় তখন স্রোতের মতো মানুষ। 

    ভিড়ের মাঝে প্রেম নিঃশব্দে জায়গা করে নিচ্ছে মনে। একটি মেয়ে শালটা টেনে দিল ছেলেটির কাঁধে। ছেলেটি হেসে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল সেই মণ্ডপে যেখানে ‘চল চঞ্চল হাওয়ার পিছে পিছে...’ বাজছে। দূরে কালী প্রতিমা সকলের দিকে তাকিয়ে। চলছে আরতি। ঘণ্টার শব্দ, কাঁসরের আওয়াজ, ঢাকের বোল, হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে সবাই। কালী সব দেখছেন উপর থেকে। বারাসতের মাইক ব্যবসায়ী পার্থসারথি করগুপ্ত বলেন, ‘অনেক বাংলা গান ওঠে। কিছু দিন চলে। তারপর শোনা যায় না। কিন্তু যে কোনও অনুষ্ঠানে ভরসা সেই পুরনো গান। আমি যে প্যান্ডেলগুলিতে মাইক ভাড়া দিয়েছি সেখানে পুরানো দিনের গানই চালাচ্ছি। মানুষ স্বর্ণযুগকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে আছে এখন।’ পুরনো গান, আলো আর ভক্তির ধোঁয়া প্যান্ডেলকে শুধু একটি উৎসব করেই রাখেনি, বরং স্মৃতিসংযোগের সেতু করে তুলেছে বারাসতে। কালীপুজো অনন্য কিছু মুহূর্তও তৈরি করে গিয়েছে দিন থেকে রাত, তা নিয়েই পথচলা। ভাবতে ভাবতেই কানে চলে আসে পান্নালালের অমর সুর-‘কোথা ভবতারা দুর্গতিহারা, কবে তোর করুণা হবে...’ 
  • Link to this news (বর্তমান)