অন্য কাজের গরিমা ম্লান বাজি নিয়ে ব্যর্থতায়, ক্ষোভ পুলিশেই
আনন্দবাজার | ২৩ অক্টোবর ২০২৫
আর কত বার বাজির পরীক্ষা দিয়ে তবে তাতে উত্তীর্ণ হবে পুলিশ? প্রতি বছর দুর্গাপুজোর সময়ে কলকাতায় ভিড় এবং যান চলাচল সামলে প্রশংসা কুড়োয় যে পুলিশ বাহিনী, তারাই কেন ধারাবাহিক ভাবে লাল কালি পায় বাজির বিধি বলবৎ করার ক্ষেত্রে? কেন বাজির পরীক্ষা এলেই সম্ভাব্য প্রশ্নের ‘সাজেশন’ মেলে না পুলিশের? কয়েক দিন ধরে এমনই নানা মন্তব্য ঘুরছে সমাজমাধ্যমে। শব্দবাজির তাণ্ডবে বিরক্ত নাগরিকেরা সেখানে উগরে দিচ্ছেন ক্ষোভ। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, শুধু সেখানেই নয়, আলোচনা শুরু হয়েছে কলকাতা পুলিশের অন্দরেও। পর পর চার বার ‘নিরাপদতম’ শহরের শিরোপা পাওয়া নিয়ে যে পুলিশ গর্ব করেছে দু’দিন আগেও, তারাই এখন চুলচেরা বিশ্লেষণে ব্যস্ত, কেন এমন হল? ঠিক কোন স্তরের গাফিলতিতে বাহিনীকে এমন সমালোচনার মুখে পড়তে হয় বার বার?
বুধবার আর এ নিয়ে নতুন করে মন্তব্য করেননি পুলিশের কোনও কর্তাই। কিন্তু ভবানী ভবনের রাজ্য পুলিশের শীর্ষ কর্তাদের থেকে বার্তা এসেছে। কেন বাজির দাপট নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, থানা স্তর থেকে সে বিষয়ে রিপোর্ট নিয়ে জানাতে বলা হয়েছে খোদ নগরপালকে। পরিস্থিতি বুঝে তিনিও সমস্ত ডিভিশন থেকে বাজি সংক্রান্ত সব রকম পরিসংখ্যান এবং তথ্য চেয়েছেন। ডিভিশনের ডিসি পদমর্যাদার অফিসারদের আলাদা করে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে সামগ্রিক ‘বাজি-ব্যর্থতা’ নিয়ে। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম নগরপাল পদমর্যাদার এক অফিসার যদিও বলেন, ‘‘দুর্গাপুজোর আগে থেকে এখন পর্যন্ত বাতাসের মান কেমন ছিল, সে ব্যাপারে নভেম্বরে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে আদালতে। সেই কারণে বাজি সংক্রান্ত তথ্যও চাওয়া হয়েছে।’’ কিন্তু বাহিনীতে গুঞ্জন চলছে, ‘‘প্রতি বছর বাজি নিয়ে এমন সামগ্রিক ক্ষোভের মুখে শুধু পুলিশ কেন পড়বে? দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ থেকে প্রশাসনিক সমস্ত স্তরই তো ব্যর্থ!’’
দক্ষিণ-পূর্ব ডিভিশনের একটি থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার বললেন, ‘‘পুলিশ চাইলে সব পারে। কিন্তু প্রতি বছর বাজি নিয়ে বুঝিয়ে কার্যোদ্ধারের পথ নেওয়া হয়।’’ কলকাতা পুলিশের পশ্চিম ডিভিশনের আর একটি থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারের মন্তব্য, ‘‘বড়কর্তাদের বিষয়টি বুঝতে হবে। বাজারে আসার আগেই যদি বাজি আটকানো না যায়, তখন যদি ব্যবসা, রাজ্যের কর্মসংস্থান আর জিডিপি-র প্রশ্ন তুলে চুপ করে থাকা হয়, পরে তো এমন হবেই।’’ কলকাতা পুলিশের এক জন উপ-নগরপালও বলছেন, ‘‘প্রশাসন থেকে খুব কিছু করা হয় না। দু’দিন বাদে মানুষ ভুলে যাবে ধরে নিয়েই হালকা চালে চোর-পুলিশ খেলা চলতে থাকে।’’ এই চোর-পুলিশ খেলার কারণেই এ বার কালীপুজো এবং তার পরের দিন শহর দেখেছে যুদ্ধক্ষেত্রের মতো পরিস্থিতি। রাত যত বেড়েছে, ততই বেড়েছে বাজির দাপট। সাহায্য চেয়ে বার বার থানায় ফোন করেও অনেকেই সুরাহা পাননি বলে অভিযোগ। ভুক্তভোগীদের দাবি, হয় ফোন কেটে দেওয়া হয়েছে, নয়তো এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে ফোন করাই না যায়। এর সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সাউন্ড বক্স, মাইকের দাপট। পাড়ায় পাড়ায় এ দিনও ডিজে বাজিয়ে জলসা চলেছে গভীর রাত পর্যন্ত। এ দিন পুলিশ ৪৩ জনকে গ্রেফতার করেছে। যার মধ্যে বাজি ফাটানোর জন্য আট জন গ্রেফতার হন। অন্যান্য বিধি ভাঙার কারণে ধৃত ৩৫ জন।
উত্তর কলকাতার একটি থানার অফিসার বললেন, ‘‘পুলিশকে বোঝানো হয়, সারা বছর যাঁদের নিয়ে এলাকায় কাজ করতে হবে, তাঁদের বিরুদ্ধে গিয়ে লাভ নেই। বাজি ফাটানো বন্ধ করতে গিয়ে লোকজনকে খেপিয়ে লাভ আছে?’’ তার মানে বেপরোয়া ভাবে বাজি ফাটানোর মতো অপরাধ দেখেও কিছু করা হবে না? বাহিনীর এক অফিসারেরই মন্তব্য, ‘‘প্রথম থেকেই তো ছাড় দেওয়া হয়। বাজি ধরা পড়লে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গ্রেফতার করে বিস্ফোরক আইনে মামলা করা হয় ঠিকই, কিন্তু আদালতে কড়া অবস্থান নেওয়া হয় না। জেল হেফাজত দেওয়ার দাবি জানানো হয়। প্রায় সব ক্ষেত্রেই বলা হয়, বিস্ফোরক তেমন উদ্ধার করা যায়নি বা ফেটে গিয়েছে। নয়তো বাজি তৈরির সময়ে বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে না দেখিয়ে তৈরি হওয়া বাজিতে আগুন ধরেছে জানিয়ে দুর্ঘটনার মতো করে ঘটনাটি দেখানো হয়। যে হেতু সিজ়ার তেমন নেই, আর নতুন করে জেরার প্রয়োজন পুলিশ দেখায় না। ফলে, জেল হেফাজত পেয়ে যান ধৃত বাজি ব্যবসায়ী। এর পরে দিন ১৪ কাটিয়েই জামিন। ফের বাজির ব্যবসা।’’
আর এক পুলিশকর্মীর মন্তব্য, ‘‘বাজি বিক্রি বা ফাটানোর অভিযোগে পুলিশ বিস্ফোরক আইনের ৯বি (১) (সি) ধারায় মামলা করতে পারে। এতে তিন বছরের জেল ও মোটা অঙ্কের জরিমানার কথা বলা আছে। সঙ্গে যুক্ত করা যায় ভারতীয় দণ্ডবিধির একাধিক ধারা। কিন্তু মামলা হওয়ার আগেই উপরতলার ফোন এসে যায়।’’
কিন্তু দায় যে নিতে হয় পুলিশকেই? যুগ্ম নগরপাল পদমর্যাদার এক অফিসার বলেন, ‘‘এ বার কড়া হওয়ার সময় এসেছে।’’ কিন্তু আর কবে? বাজির ধোঁয়ায় শহরের কালো আকাশের মতোই উত্তর ধোঁয়ায় ঢাকা।