• সাপের দংশন থেকে অবশেষে শাপমুক্তি! নিজস্ব এভিএস পেতে চলেছে বাংলা
    প্রতিদিন | ২৩ অক্টোবর ২০২৫
  • গৌতম ব্রহ্ম: অবশেষে শাপমোচন! নিজস্ব অ্যান্টি-ভেনম সিরাম পেতে চলেছে বাংলা। বিষ সংগ্রহের জন্য আগেই বরাত দেওয়া হয়েছে একটি সংস্থাকে। এবার সেই বিষ থেকে এভিএস তৈরির চূড়ান্ত ছাড়পত্রও দেওয়া হল দু’টি সংস্থাকে। ১০ নভেম্বরের মধ্যেই চুক্তিপত্র চূড়ান্ত করে জমা দিতে বলা হয়েছে সংস্থা দু’টিকে। তারপরই শুরু হয়ে যাবে এভিএস তৈরির প্রক্রিয়া। বিষ সংগ্রহ, সেই বিষ ঘোড়ার শরীরে প্রবেশ করানো। ঘোড়ার রক্তে অ‌্যান্টিবডি তৈরি হলে তার থেকে নিয়ম মেনে এভিএস তৈরি করা হবে। তবে শুধু লিকুইড ফরম্যাটে নয়, পাউডার হিসাবেও তৈরি হবে অ্যান্টি-ভেনম সিরাম। এর ফলে দীর্ঘদিন ফ্রিজ ছাড়াও সংরক্ষণ করা যাবে এভিএস। ফলে উপকৃত হবে বহু প্রান্তিক এলাকার মানুষ। স্বাস্থ্যদপ্তর সূত্রে এমনটাই জানা গিয়েছে।

    চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপারস, স্কেলড ভাইপার, স্পেকটাকল কোবরা বা গোখরো, কমন ক্রেট বা কালাচ। এই চার প্রজাতির (বিগ ফোর) সাপের বিষ নিয়ে পলিভালেন্ট এভিএস তৈরি হয়। অর্থাৎ এই একটাই ওষুধ চার প্রজাতির সাপের দংশনেই কার্যকর হবে।

    কিন্তু সমস্যা অন্যত্র। এই ফর্মুলায় ‘স স্কেলড ভাইপার’-ও আছে। বাংলায় যার কোনও অস্তিত্ব নেই। তাই শুধু এই সাপের বিষ বাইরে থেকে সংগ্রহ করতে হবে অ্যান্টি-ভেনম সিরাম প্রস্তুতকারকদের। আসলে প্রথমে এই সর্পবিষ বাদ দিয়ে মনোক্লেড কোবরা বা কেউটের বিষকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব উঠেছিল স্বাস্থ্য দপ্তরের ডাকা বিশেষজ্ঞদের বৈঠকে। কিন্তু সেক্ষেত্রে ফরমুলেশন বদলে যাওয়ায় আবার নতুন করে ক্লিনিক‌্যাল ট্রায়াল আবশ্যিক হবে। যা সম্পূর্ণ করতে সাত-আট বছর লেগে যাবে। ফলে আরও অনেকদিন নিজস্ব অ্যান্টি-ভেনম সিরাম থেকে বঞ্চিত থাকবে বাংলা। তাই সেই প্রস্তাব গ্রহণ করা যায়নি।

    রাজ্যে দীর্ঘদিন ক্লিনিক‌্যাল ট্রায়াল নিয়ে কাজ করছে ‘অ্যাভয়েডেবল ডেথ নেটওয়ার্ক’। সংস্থার আঞ্চলিক সঞ্চালক স্নেহেন্দু কোনার জানালেন, বিষ সংগ্রহ থেকে এভিএস তৈরি, লম্বা প্রক্রিয়া। যা সম্পূর্ণ হতে কমপক্ষে ১৮ মাস সময় লাগার কথা। অর্থাৎ সব ঠিকঠাক থাকলে ২০২৭ সালে বাংলা পাবে নিজস্ব এভিএস। কিন্তু যদি নতুন ফর্মুলেশনে যায় অর্থাৎ ‘স স্কেলড ভাইপার’ বাদ দিয়ে মনোক্লেড কোবরা বা কেউটেকে অন্তর্ভুক্ত করে এভিএস তৈরির পথে এগোয় তবে একাধিক সিডিএসসিও, এথিক্স কমিটির হার্ডলস পেরিয়ে ট্রায়াল, ডকুমেন্টেশন হয়ে কোনও জার্নালে পেপার প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত সাত-আট বছরের ধাক্কা।

    স্বাস্থ্যভবন সূত্রের খবর, দেশে মোট চারটি সংস্থা অ্যান্টি-ভেনম সিরাম তৈরি করে। এদের মধ্যেই দু’টি সংস্থা রাজ্যের চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে। জানা গিয়েছে, পাউডার এভিএসের ক্ষেত্রে ৬৫০ টাকা ও ইঞ্জেকশনের ক্ষেত্রে ৩৯৯.৬০ টাকা প্রতি ১০ মিলির দাম চূড়ান্ত হয়েছে। দশ ভায়ালের প‌্যাক তৈরি করে রাজ্যের ‘সেন্ট্রাল মেডিক‌্যাল স্টোর’-কে সরবরাহ করবে এই দুই বেসরকারি সংস্থা।

    আসলে, তামিলনাড়ুর মহাবলীপুরম ও সংলগ্ন জেলার সাপ থেকে যে বিষ সংগ্রহ করা হয়, সেটিই এ দেশে এভিএস তৈরির ক্ষেত্রে কাজে লাগায় পুণে, মুম্বই, হায়দরাবাদ ও কসৌলি ল‌্যাবগুলি। এভিএস প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলিও ওই ল্যাবগুলির তৈরি অ্যান্টিবডি কাজে লাগিয়ে অ্যান্টি-ভেনাম সেরাম উৎপাদন করে।

    অথচ পূর্ব ভারতের, বিশেষ করে বাংলায় সাপের বিষের মধ্যে থাকা প্রোটিন দক্ষিণ ভারতের ওই একই সাপের বিষের প্রোটিনের থেকে গঠনগতভাবে অনেকটাই আলাদা। ফলে প্রচলিত এভিএস বাংলার সর্পদষ্ট রোগীদের শরীরে পুরোপুরি কাজ করছিল না। এবার কাজ করবে। এমনটাই জানালেন রাজ্যের অন্যতম বিষ বিশেষজ্ঞ তথা বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক‌্যালের অধ্যাপক ডা. সোমনাথ দাস। .

    একই বক্তব্য রাজ্যের স্নেকবাইট ট্রেনিং কর্মসূচির প্রধান চিকিৎসক ডা. দয়ালবন্ধু মজুমদারেরও। তাঁর পর্যবেক্ষণ, “তামিলনাড়ুর বিষ থেকে তৈরি এভিএস বাংলার চন্দ্রবোড়ার দংশনে ঠিকমতো কাজ করছিল না। যে রোগীর ১০ ভায়ালে কাজ হয়ে যাওয়ার কথা, তাকে ৩০ ভায়াল দিয়েও লাভ হচ্ছে না অনেক সময়ে।”

    তাই পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুরের ‘সীতাপুর নবীন মানুয়া সৃষ্টি ফাউন্ডেশন’ এবং দাসপুরেরই গোমকপোতা গুণধর বিদ্যামন্দির নামের একটি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের সব শিক্ষকও একই দাবি নিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ‌্যায়কে। ওই স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক সুব্রত বুরাই বলেন, ‘‘বাংলার নিজস্ব এভিএসের অভাবে বহু প্রাণহানি হচ্ছে। সময়ে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও অনেক ক্ষেত্রে রোগীকে বঁাচানো যাচ্ছে না। নিজস্ব এভিএস পেলে শাপমুক্তি ঘটবে।’’

    আগে কলকাতার বেঙ্গল কেমিক্যালে এভিএস তৈরি হত। ঘোড়া থেকে শুরু করে সব পরিকাঠামো মজুত ছিল। সর্পবিশারদ দীপক মিত্র বিষ সংগ্রহে সাহায্য করতেন। কিন্তু ২০০৬-২০০৭ অর্থবর্ষে বেঙ্গল কেমিক‌্যালে এভিএস উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় দুই দশক পর ফের বাংলার মাটিতে এভিএস তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হল।
  • Link to this news (প্রতিদিন)