নদীর দুই তীরে পায়ে হেঁটে যাত্রা কিন্তু কখনও নদী পার নয়, কোন ধর্মীয় মাহাত্ম্য রয়েছে ভারতের এই নদীতে ...
আজকাল | ২৪ অক্টোবর ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: ভারতের অধিকাংশ নদী পূর্বমুখী হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশে যায়। কিন্তু একমাত্র প্রধান নদী হিসেবে নর্মদা নদী এই প্রথা ভেঙে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে আরব সাগরে গিয়ে মিশেছে। এই ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের জন্যই নর্মদা ভারতের অন্যতম অনন্য ও গুরুত্বপূর্ণ নদী হিসেবে পরিচিত। মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে জীবন, কৃষি ও সভ্যতার ধারক এই নদী আজও দেশের এক অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ।
নর্মদা নদীর উৎপত্তিস্থলনর্মদা নদীর উৎপত্তি মধ্যপ্রদেশের অনুপপুর জেলার অমরকণ্টক পাহাড় থেকে। এই পাহাড়গুলি বিন্ধ্য ও সাতপুরা পর্বতমালার সংযোগস্থলে অবস্থিত। এখান থেকেই নদীটির পশ্চিমমুখী দীর্ঘ যাত্রা শুরু হয়। অমরকণ্টককে হিন্দুধর্মে এক পবিত্র স্থান হিসেবে গণ্য করা হয়, এবং প্রতিবছর হাজার হাজার তীর্থযাত্রী এই স্থান পরিদর্শনে আসেন নর্মদার জন্মস্থান দর্শনের জন্য। এই উৎস থেকেই নর্মদা ধীরে ধীরে প্রবাহিত হয়ে মধ্য ভারতের শুষ্ক ও উর্বর ভূমিকে জীবনদান করে।
দৈর্ঘ্য ও প্রবাহপথনর্মদা নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ১,৩১২ কিলোমিটার। এর সম্পূর্ণ প্রবাহপথে নদীটি কখনও ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে, কখনও পাথুরে উপত্যকার ভেতর দিয়ে বয়ে যায়। নদীটির পশ্চিমমুখী প্রবাহের কারণ হলো বিন্ধ্য ও সাতপুরা পর্বতমালার মাঝের প্রাকৃতিক ঢাল। এই দুই পর্বতের মাঝখানে একটি গভীর রিফ্ট ভ্যালি বা উপত্যকা গঠিত হয়েছে, যা নর্মদার প্রবাহকে পূর্ব থেকে পশ্চিমের দিকে পরিচালিত করে।
যে রাজ্যগুলির মধ্য দিয়ে নর্মদা প্রবাহিতনর্মদা নদী ভারতের তিনটি রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে—মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ও গুজরাট। এর মধ্যে মধ্যপ্রদেশেই নদীটির সবচেয়ে দীর্ঘ অংশ অবস্থিত। এখানে নদীটি অসংখ্য গ্রাম, শহর ও কৃষিজমিকে জল দিয়ে জীবনধারার উৎস তৈরি করেছে। মহারাষ্ট্রের সীমান্ত ছুঁয়ে নদীটি গুজরাতে প্রবেশ করে এবং শেষ পর্যন্ত ভরুচ জেলার কাছে খম্ভাত উপসাগর হয়ে আরব সাগরে মিলিত হয়।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পর্যটন কেন্দ্রনর্মদা নদীর আশেপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটক ও তীর্থযাত্রী উভয়ের কাছেই অত্যন্ত আকর্ষণীয়। নদীর অন্যতম বিখ্যাত স্থান হল ভেদাঘাটের মার্বেল শিলা, যেখানে নদীটি সাদা মার্বেল পাহাড় কেটে প্রবাহিত হয়েছে। এখানেই রয়েছে বিখ্যাত ধুয়াঁধার জলপ্রপাত, যা পর্যটকদের জন্য বড় আকর্ষণ। নদীর উপত্যকাজুড়ে বিস্তৃত বনভূমি, বন্যপ্রাণী এবং মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্য মধ্য ভারতের অপার সৌন্দর্যের প্রতীক।
ধর্মীয় গুরুত্বনর্মদা শুধু একটি ভৌগোলিক বিস্ময় নয়, এটি হিন্দুধর্মে এক পবিত্র নদী। বিশ্বাস করা হয়, এর জলে স্নান করলে পাপ মোচন হয় এবং আশীর্বাদ লাভ করা যায়। বহু ভক্ত “নর্মদা পরিক্রমা” নামের এক আধ্যাত্মিক যাত্রা সম্পন্ন করেন, যেখানে তারা নদীর দুই তীর ধরে পায়ে হেঁটে যাত্রা করেন, কিন্তু কখনও নদী পার হন না। প্রাচীন পুরাণ ও ধর্মগ্রন্থেও নর্মদার উল্লেখ রয়েছে, যেখানে তাঁকে দেবী নর্মদা রূপে পূজা করা হয়।
অর্থনৈতিক ও কৃষি গুরুত্বনর্মদাকে বলা হয় “মধ্যপ্রদেশ ও গুজরাটের প্রাণরেখা”। এটি পানীয় জল, সেচ এবং শিল্পক্ষেত্রে অপরিহার্য ভূমিকা রাখে। নদীর ওপর নির্মিত সর্দার সরোবর বাঁধ ও ইন্দিরা সাগর বাঁধ বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচ ব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নদীটি মধ্য ভারতের কৃষকদের গম, তুলা, আখ ও ডালশস্য উৎপাদনে সহায়তা করে, যা আঞ্চলিক অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে।
ভূতাত্ত্বিক গুরুত্বনর্মদা উপত্যকা ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূতাত্ত্বিক অঞ্চল। এখানে প্রাগৈতিহাসিক জীবাশ্ম ও প্রাচীন মানবজাতির নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। ভূগোল অনুযায়ী, এই উপত্যকা উত্তর ভারতের সমভূমি ও দক্ষিণের ডেকান মালভূমির মধ্যে একটি প্রাকৃতিক বিভাজন রেখা তৈরি করে।নর্মদা নদী শুধু একটি নদী নয়—এটি ভারতের প্রাকৃতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। পূর্ব থেকে পশ্চিমে তার প্রবাহ যেমন বিরল, তেমনি এর জীবনদায়িনী শক্তি আজও কোটি মানুষের আশা ও বিশ্বাসের উৎস।