• এসআইআর: পশ্চিমবঙ্গে প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে, কী কী নথি লাগবে, কাদের নাম বাদ যেতে পারে, সব নাড়িনক্ষত্র জেনে নিন একনজরে
    আনন্দবাজার | ২৪ অক্টোবর ২০২৫
  • পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) নিয়ে নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে। আগামী বছর রাজ্যে বিধানসভা ভোট। প্রত্যাশিত ভাবেই, তার আগে তালিকা সংশোধনের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা নিয়েছে কমিশন। এসআইআরের চূড়ান্ত তালিকা ধরেই পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন করতে চাইছে তারা। যেমন বিহারে হচ্ছে। বিহারের বিধানসভা ভোট আসন্ন। যেমন আসন্ন পশ্চিমবঙ্গের জন্য সংশোধন শুরুর দিন ঘোষণা। অনেকেরই প্রশ্ন, পশ্চিমবঙ্গের এসআইআরে কী কী নথি প্রয়োজন? কাদের নাম তালিকা থেকে বাদ যেতে পারে? কারা অবৈধ ভোটার? বিহারের এসআইআরের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের এসআইআরের কী পার্থক্য রয়েছে? প্রশ্নোত্তরে জবাব খুঁজল আনন্দবাজার ডট কম।

    এসআইআর কী জন্য দরকার?

    প্রতি বছরই ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ করে নির্বাচন কমিশন। নতুন নাম নথিভুক্ত করার পাশাপাশিই মৃত এবং অবৈধ ভোটারের নাম বাদ দিয়ে নতুন তালিকা প্রকাশ করা হয়। কিন্তু কমিশন মনে করছে, ওই প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ এবং ‘নিবিড়’ নয়। নাম তোলা এবং বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক গলদ থেকে গিয়েছে। এসআইআর করে সব ভোটারের নাম নতুন করে নথিভুক্ত করা হবে। নিশ্চিত করা হবে দু’টি বিষয়। এক, কোনও বৈধ ভোটার যেন বাদ না যান। দুই, একজনও অবৈধ ভোটার যেন তালিকায় না থাকেন। পশ্চিমবঙ্গে ২০০২ সালে ভোটার তালিকায় শেষ বার আমূল বিশেষ সংশোধন হয়েছিল। গত ১০-১৫ বছরে গোটা দেশে এই কাজ আর করেনি কমিশন। এখন সংশোধন করার প্রসঙ্গে কমিশনের বক্তব্য, এসআইআরের জন্য নির্দিষ্ট কোনও দিনক্ষণ নেই। প্রয়োজন মনে হলে করা হয়। যদিও কংগ্রেস, তৃণমূল-সহ বিরোধী দলগুলির বক্তব্য, এসআইআরে ‘বিজেপির ভাবনা’ কাজ করছে। বিজেপির ধারণা, বাংলাদেশ এবং মায়ানমার থেকে ভারতে ঢোকা প্রায় এক কোটি অনুপ্রবেশকারী এ দেশের ভোটার তালিকায় রয়েছেন। কমিশনকে দিয়ে এসআইআর করিয়ে সেই নামগুলি বাদ দিতে চায় বিজেপি। তাই এত বছর পরে এসআইআর হচ্ছে।

    কী কী নথি প্রয়োজন?

    এসআইআরের জন্য প্রত্যেকের বাড়িতে ‘এনুমারেশন ফর্ম’ পোঁছে দেবেন বুথ লেভেল অফিসারেরা। সেই ফর্মের সঙ্গে কমিশনের বেঁধে দেওয়া ১১টি নথি দিতে হবে। বিহারের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। কমিশন সূত্রের খবর, দু’-একটি পরিবর্তন ছাড়া বিহারের মতো পশ্চিমবঙ্গেও একই ভাবে এসআইআর হবে। সেই অনুযায়ী, এই রাজ্যে ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় নাম রয়েছে, এমন ব্যক্তিদের কোনও নথিই দিতে হবে না। ওই তালিকায় নাম দেখাতে পারলেই এ বারের এসআইআরে তাঁদের নাম উঠে যাবে। এসআইআরে ১১টি নথি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে কমিশন। সুপ্রিম কোর্ট পরিচয়পত্র হিসাবে আধার কার্ড গ্রহণ করতে বলেছে। কমিশন জানিয়েছে, ওই ১১টির মধ্যে যে কোনও একটি নথি এবং ২০০২ সালের তালিকায় বাবা অথবা মায়ের নাম রয়েছে প্রমাণ করতে পারলেই নতুন তালিকায় নাম উঠবে।

    কমিশনের নির্দিষ্ট ১১টি নথি কী কী?

    ১) কেন্দ্রীয় অথবা রাজ্য সরকারের কর্মী হিসাবে কাজ করেছেন অথবা পেনশন পান এমন পরিচয়পত্র। ২) ১৯৮৭ সালের ১ জুলাইয়ের আগে ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস, এলআইসি, স্থানীয় প্রশাসনের দেওয়া যে কোনও নথি। ৩) জন্ম শংসাপত্র। ৪) পাসপোর্ট। ৫) মাধ্যমিক বা তার অধিক কোনও শিক্ষাগত শংসাপত্র। ৬) রাজ্য সরকারের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের দেওয়া বাসস্থানের শংসাপত্র। ৭) ফরেস্ট রাইট সার্টিফিকেট। ৮) জাতিগত শংসাপত্র। ৯) কোনও নাগরিকের ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার। ১০) স্থানীয় প্রশাসনের দেওয়া পারিবারিক রেজিস্ট্রার। ১১) জমি অথবা বাড়ির দলিল।

    এ ছাড়াও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মোতাবেক পরিচয়পত্র হিসাবে আধার কার্ড দেখানো যাবে। তবে তা দেখিয়ে নাগরিকত্বের দাবি করা যাবে না। কমিশন জানিয়েছে, আধার কার্ডের সঙ্গে এই ১১টি নথির যে কোনও একটি দিতে হবে। এই ১১টি নথির বাইরে কোনও নথি যদি নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারে, তবে তা-ও গ্রহণ করা হবে।

    এসআইআর ঘোষণার পরেই দিল্লি থেকে এনুমারেশন ফর্মের ‘সফ্‌ট কপি’ নির্বাচনী নিবন্ধন আধিকারিক (ইআরও)-দের পোর্টালে পাঠিয়ে দেবে কমিশন। তার পরে সেগুলি যাবে ছাপার জন্য। এখনকার ভোটার তালিকায় নাম রয়েছে, এমন সকলেই এনুমারেশন ফর্ম পাবেন। প্রত্যেক ভোটারের এনুমারেশন ফর্ম আলাদা। ভোটারের এপিক নম্বর, নাম, ঠিকানা, জন্মতারিখ-সহ ৯০ শতাংশ তথ্য ফর্মে ছাপা থাকবে। একজন ভোটারপ্রতি দু’টি করে এনুমারেশন ফর্ম ছাপবে কমিশন। এখন পশ্চিমবঙ্গের ভোটার সংখ্যা প্রায় ৭.৬৫ কোটি। তার দ্বিগুণ ফর্ম ছাপা হবে। ওই ফর্মগুলি প্রত্যেক ভোটারের বাড়িতে পোঁছে দেবেন বিএলও-রা। ফর্মের বাকি অংশ পূরণ করে উপযুক্ত নথি-সহ জমা দিতে হবে। একটি ফর্ম সংশ্লিষ্ট ভোটারের কাছে থাকবে। অন্যটি বিএলও নিয়ে যাবেন।

    কাদের নাম বাদ যাবে?

    ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় পরিবারের কারও নাম নেই এবং ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন, এমন ব্যক্তিদের নাম তালিকা থেকে বাদ দিতে পারে কমিশন। ভোটার তালিকায় থাকা সব মৃত এবং অবৈধ ভোটারের নাম বাদ পড়বে। যাঁরা অন্যত্র চলে গিয়েছেন বা যাঁদের নাম দু’টি এপিক নম্বরে দু’জায়গায় রয়েছে তাঁদের নাম এক জায়গা থেকে বাদ পড়বে। কারচুপি করে তালিকায় নাম তোলা ব্যক্তিরা ‘অবৈধ ভোটার’। এ ক্ষেত্রে বিশেষত বাংলাদেশ এবং মায়ানমার থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীদের ইঙ্গিত করা হয়েছে। কমিশন মনে করছে, কারচুপি করে ওই ১১টি নথির মধ্যে কোনও একটি তৈরি করা গেলেও ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বাবা বা মায়ের নাম দেখাতে পারবেন না। স্বাভাবিক ভাবেই তখন নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। ভারতের নাগরিক প্রমাণ করতে না পারলে নাম বাদ যাবে।

    পশ্চিমবঙ্গে কত নাম বাদ যেতে পারে?

    এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনও তথ্য কমিশনের কাছে নেই। তবে আধিকারিকদের একাংশের অনুমান, এক কোটির কাছাকাছি নাম বাদ পড়তে পারে। তাঁদের যুক্তি, ২০০২ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরের হিসাব ধরলে মৃত এবং অন্যত্র চলে গিয়েছেন, বাদ পড়া এমন ভোটারের সংখ্যা কমপক্ষে ৭৫ লক্ষ। এর সঙ্গে গত ২৩ বছরে অবৈধ ভোটার ধরলে সংখ্যাটি কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে। তবে এ সবই অনুমানের ভিত্তিতে বলা হচ্ছে।

    নতুন নাম নথিভুক্ত করা যাবে?

    যাবে। কোনও ভোটার তালিকায় নাম নেই, এমন ব্যক্তিদের নতুন করে ভোটার তালিকায় নাম তোলাতে হবে। তাঁরা এনুমারেশন ফর্ম পাবেন না। তাঁদের কমিশনের ৬ নম্বর ফর্মে আবেদন করে নাম নথিভুক্ত করতে হবে। কমিশনের আগের বেঁধে দেওয়া নিয়মেই নাম তোলা যাবে।

    এসআইআরে অংশ না নিলে কী হবে?

    এসআইআর হলে ২০২৬ সালে নতুন ভোটার তালিকা প্রকাশ করবে কমিশন। কোনও ভোটার এসআইআরে অংশ না নিলে নতুন তালিকা থেকে তাঁর নাম বাদ যাবে। তিনি আগামী বিধানসভা নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন না। নতুন ভোটার তালিকায় নাম রাখতে গেলে যে কোনও উপায়ে এসআইআর প্রক্রিয়ায় আসতেই হবে।

    এসআইআরের ম্যাপিং কী?

    ২০০২ সালে রাজ্যে ভোটার ছিল ৪.৫৮ কোটি। এখন তিন কোটি বেড়ে মোট ভোটারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭.৬৫ কোটি। যার উপর ভিত্তি করে বিশেষ সংশোধন করতে চলেছে নির্বাচন কমিশন। প্রথমে কমিশন জেলা নির্বাচনী আধিকারিক, নির্বাচনী নিবন্ধন আধিকারিক, বিএলওদের নিয়ে ম্যাপিংয়ের কাজ করছে। ২০০২ সালের সঙ্গে ২০২৫ সালের ভোটার তালিকা মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। দুই তালিকাতেই যাঁদের নাম রয়েছে, তাঁরা ম্যাপিংয়ের আওতায় আসছেন। অর্থাৎ, ওই ভোটারদের চিহ্নিত করা গিয়েছে। তাঁদের পরিবারের সদস্যেরা যে ভারতীয় নাগরিক, সে বিষয়ে একপ্রকার নিশ্চিত কমিশন। তাঁদের নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসাবে কোনও নথির প্রয়োজন নেই। বাংলায় ‘ম্যাপিং’ হলেও বিহারে তা করেনি কমিশন। তাদের বক্তব্য, এটি একটি ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’। ম্যাপিং করে শুধু কাজ এগিয়ে রাখা হচ্ছে।

    ২০০২ সালের তালিকা কোথায় পাওয়া যাবে?

    সিইও দফতরের ওয়েবসাইটে ওই তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। তখনকার বিধানসভা এলাকা অনুযায়ী তালিকা প্রকাশিত করা আছে। ভোটগ্রহণ কেন্দ্র মিলিয়ে নাম রয়েছে কি না তা যাচাই করতে পারবেন ভোটারেরা। প্রয়োজনে রাজনৈতিক দলের বুথ লেভেল এজেন্টদের সাহায্য নিতে পারবেন ভোটাররা।

    এসআইআর তালিকা কী ভাবে প্রকাশিত হবে?

    বিহারে এক মাসের মধ্যে এসআইআরের মূল কাজ শেষ করেছে কমিশন। তার পরে খসড়া তালিকা প্রকাশিত হয়। সেখানে কোনও ভুল রয়েছে কি না বা কোনও অভিযোগ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখে কমিশন। খসড়া তালিকার প্রায় এক মাস পরে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হবে।

    চলতি সপ্তাহে সারা দেশে এসআইআরের প্রস্তুতির দ্বিতীয় পর্যায়ের বৈঠক করেছে কমিশন। দিল্লিতে বুধ এবং বৃহস্পতিবার এই দু’দিন ধরে চলেছে ওই বৈঠক। আগামী বছর ভোট রয়েছে, এমন রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক (সিইও)-দের সঙ্গে আলাদা করে বৈঠক করেছে কমিশন। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমারের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাংলার সিইও মনোজ আগরওয়াল। কমিশন সূত্রের খবর, বিএলও নিয়োগ নিয়ে কিছু অসুবিধা থাকলেও বাকি সব প্রস্তুতি সারা হয়েছে বলে নির্হাচন কমিশনারকে জানিয়েছেন পশ্চিবঙ্গের সিইও মনোজ।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)