পার্থ চৌধুরী: পুজো (Durga Puja) থেকে দীপাবলী (Diwali) হয়ে ছট পুজো (Chhat)। কিন্তু শব্দবাজির (Fire Cracker) ভূত পিছু ছাড়ছে না মফসসল এলাকাতেও। এই আওয়াজে প্রবীণ, অসুস্থ মানুষদের যেমন কষ্ট হয়, ঠিক তেমনই চরম অসুস্থ হয়ে পড়ে গৃহপালিত কুকুর-বিড়ালরাও। রাস্তার কুকুর বা বিড়ালরা তো আরও অসহায়। তাদের গায়ে পটকা ফাটিয়ে, লেজে বাজি বেঁধে বিকৃত আনন্দ পায় কিছু মানুষ!
কথা না-বলা বন্ধু
বাড়ির কুকুররাও চরম অসহায়। গত কয়েকবছর ধরে বর্ধমানেও কলকাতার মতো কুকুর বা বিড়াল পোষার প্রবণতা বাড়ছে। শহরে এখন গোটা পঞ্চাশেক পেট শপ। বেশ কিছু ভেটেরিনারি ক্লিনিক, হাসপাতাল। সরকারি পরিষেবার পাশাপাশি এর সংখ্যাবৃদ্ধি বুঝিয়ে দেয়, এই অবলা বন্ধুদের প্রতি মানুষের আস্থা আরও বেড়েছে। বেশ কয়েকটি পশুপ্রেমী সংস্থাও পথকুকুরদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
কোভিড থেকেই বদল
পূর্ব বর্ধমানের জেলা শহর বর্ধমান। কোভিডের সময় মানুষ যখন একলা হয়ে পড়েন, তখন পোষ্য নির্ভরতা বেড়ে যায় এখানে। পশুপাখিদের নিয়ে ধারাবাহিক কাজ করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ড. পার্থ সরকার। তিনি জানাচ্ছেন, পোষ্য রাখার আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে। বর্ধমান ও লাগোয়া এলাকায় পোষ্যের সংখ্যা বেশ কয়েক হাজার। এর মধ্যে কুকুর,বিড়াল সবই আছে। একটি পরিসংখ্যানের সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি, পোষ্য কুকুর বেড়ালের সংখ্যা কুড়ি হাজারের কাছাকাছি হতে পারে। সকালে যে কোনওদিন তেঁতুলতলা, নীলপুর, পুলিস লাইন বা রথতলা বাজারে গেলে বোঝা যায়, কত মানুষ কুকুর বা বিড়ালের জন্য মাছ,মাংস কিনতে আসছেন।
শব্দবাজির দাপট
গত কয়েকদিন ধরে শব্দবাজির দাপট ক্রমশ বাড়ছে। সারা বছর নানা অনুষ্ঠানে শব্দের অত্যাচার বাড়ে। তবে এ বছর পুজোর সময় শব্দের দাপট অনেকটাই কম ছিল। কিন্তু সেটা পুষিয়ে দিল দীপাবলি। কালীপুজোর রাত থেকে কানফাটানো শব্দে শহরের নানা প্রান্তে বাজি,পটকা ফেটেই চলেছে। ছট পুজো অবধি এই অত্যাচার চললে, কী হবে ভাবতে ভয় পাচ্ছেন পশুপ্রেমীরা। গত কয়েকদিনে চিত্রটা উদ্বেগজনক চেহারা নিয়েছে। বর্ধমানের ঘোড়দোড়চটি বা মুচিপাড়ার দুটি বেসরকারি হাসপাতালে কয়েকশো রোগী এসেছে। কুকুর বেশি, বিড়াল কম। এর মধ্যে সব প্রজাতিই আছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ড. জাহাঙ্গীর খান জানালেন এই অবলাদের বিপন্নতার কথা।
শারীরিক এবং মানসিক ক্ষতি, মানসিক চাপ ও ভয়:
বোমার বিকট শব্দে কুকুরদের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এর ফলে তারা খাবার খাওয়া বন্ধ করে দিতে পারে বা খুব বেশি কুঁকড়ে থাকতে পারে। শ্রবণশক্তির ক্ষতি হতে পারে। অতিরিক্ত উচ্চ শব্দে তাদের শ্রবণশক্তি চিরস্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ড. খান আরও জানান, হৃদরোগের ঝুঁকিও থাকে। তীব্র শব্দের কারণে কুকুরদের হার্ট অ্যাটাক হওয়ারও আশঙ্কা থাকে।
অজ্ঞান হয়ে যাওয়া:
কিছু ক্ষেত্রে শব্দের তীব্রতা এত বেশি হয় যে, কুকুররা অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে।
আচরণগত সমস্যা:
ভয়ের কারণে তারা দিশেহারা হয়ে ছুটোছুটি করতে পারে, যা তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে।
রাস্তার কুকুরের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বিবাদ:
অতিরিক্ত শব্দের কারণে তারা নিজেদের পরিচিত এলাকা ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যায় এবং সেখানে অন্য কুকুরদের সঙ্গে তাদের ঝগড়াও হতে পারে।
ড. জাহাঙ্গীর খান আরও জানান, এর ফলে পোষ্যদের দেহের উষ্ণতা বেড়ে যেতে পারে। এছাড়াও অতিরিক্ত আওয়াজে কুকুরদের রক্তচাপ বেড়ে যায়।
সতর্ক
অন্য দিকে, একটি পেট হাসপাতালের কর্ণধার বৈশাখী চক্রবর্তী জানান, 'ওরা কথা বলতে পারে না। কিন্তু ওদের কষ্ট অবর্ণনীয়। বিভিন্ন ব্রিডের কুকুররা এতে আক্রান্ত হচ্ছে। তারা খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিচ্ছে। মাথা গুঁজে পড়ে থাকছে। হাসপাতালে নিয়ে আসতে হচ্ছে তাদের। এ ব্যাপারে এই সময় কুকুর যাঁরা পোষেন তাঁদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। তাঁদের ভয় কাটাতে সঙ্গ দিতে হবে। সাহায্য করতে হবে।
ভীত
প্রাণী প্রশিক্ষক ও পশুপ্রেমী অর্ণব দাস দীর্ঘদিন বিভিন্ন পশুপাখি নিয়ে কাজ করে আসছেন। তিনি জানান, কুকুর খুব সংবেদনশীল প্রাণী। শব্দের কম্পাঙ্ক সহ্যসীমার বাইরে হলে এরা অস্থির হয়ে পড়ে। খাওয়া বন্ধ করে। মালিক বা প্রিয়জনকে খোঁজে। আড়াল বা খাটের নীচে চলে যেতে চায়। তীব্রতা বেশি হলে হৃদজনিত সমস্যা হতে পারে। তাঁর পর্যবেক্ষণ-- বড় এবং শক্তিশালী ব্রিডগুলিও রীতিমতো আতঙ্কিত হয় বাজির শব্দে। তাঁর মতে, এই সময়ে ভীত পোষ্যটিকে যথেষ্ট সঙ্গ দিতে হবে। বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করা উচিত নয়।
পরিযায়ী পাখি
তাঁর আরও পর্যবেক্ষণ, দীপাবলির অতিরিক্ত আলো পরিযায়ী পাখিদেরও বিপদে ফেলছে। তারা প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট দুরত্ব অতিক্রম করে। কিন্তু রাতের আলো ঝলমলে আকাশে তারা বিভ্রান্ত হয়। উড়ে যায় ক্ষমতার বেশি। এর ফলে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। বেশ কিছু পাখিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে আজকাল। তাঁর মতে, এই নিয়ে আরও গবেষণা ও সচেতনতার প্রয়োজন। সংখ্যায় কম হলেও খরগোশ, পাখিও এতে আক্রান্ত হচ্ছে।
প্রতিক্রিয়া
পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ বিশ্বনাথ রায় জানান, শব্দবাজির ক্ষতিকর দিক নিয়ে সচেতনতা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। তাঁরা চান, সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও এগিয়ে এলে ভাল হয়। ঘরে যাঁরা পোষ্য রাখেন, তাঁদের একজন সমাজকর্মী সমাপ্তিকা মণ্ডল। তাঁর মতে, আনন্দ উদযাপনের অনেক উপায় আছে। প্রচুর শব্দহীন আতসবাজি আছে, আলো আছে। শব্দদানবের আশ্রয় যাঁরা নেন, তাঁরাও এক ধরনের দানব। তাঁর কথায়, শব্দের ফলে আতঙ্কিত প্রাণীদের পাশে থাকতে হবে। ব্যবসায়ী ও ভূপর্যটক শান্তনু পাঁজার বাড়ি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশেই। তিনি জানাচ্ছেন, শব্দবাজি মানুষের মতোই একইভাবে প্রাণীদের কষ্ট ডেকে আনে। তাঁর প্রশ্ন, আর কবে সচেতন হব আমরা?
এদিকে শহরের পেট শপগুলিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, গত কয়েকদিন উদ্বেগ কাটানোর সবচেয়ে প্রচলিত ওষুধগুলি কাউন্টারে আসতে না আসতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। কয়েকটি আয়ুর্বেদিক ওষুধ ছাড়াও কিছু রাসায়নিক ওষুধ আছে এক্ষেত্রে। তীব্রতা বেশি হলে পশুচিকিৎসকের নির্দেশমতো চিকিৎসা করতে হয়।