• ‘জিহাদি-মুক্ত দিল্লি’ গড়ার দিল বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, ছট্‌ পূজার প্রাক্কালে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের আশঙ্কা!...
    আজকাল | ২৫ অক্টোবর ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক: বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) দিল্লিতে ছট্‌ পূজার প্রাক্কালে এক নতুন প্রচারাভিযান শুরু করেছে, যার অংশ হিসেবে তারা ‘সনাতন প্রতিষ্ঠা’ নামের স্টিকার বিতরণ করছে এবং সঙ্গে নেওয়া হচ্ছে এক অঙ্গীকার—‘জিহাদি-মুক্ত দিল্লি’ গড়ার প্রতিশ্রুতি। সংগঠনটির দাবি, এই উদ্যোগের লক্ষ্য হলো ভক্তদের কাছে ‘বিশুদ্ধ ও বিশ্বাসযোগ্য’ পূজার সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু পর্যবেক্ষকদের মতে, এটি মুসলমান ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বয়কটের নতুন কৌশল মাত্র।

    দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ ড. শামসুল ইসলাম এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “এ ধরনের প্রচার আসলে জনগণের প্রকৃত সমস্যা—জল, বিদ্যুৎ ও আবাসন—থেকে মনোযোগ সরানোর জন্য করা হচ্ছে। বিশেষ করে দিল্লিতে বসবাসরত বিহারিদের অবহেলা ঢাকতেই এসব আয়োজন।”

    ভিএইচপি-র ইন্দ্রপ্রস্থ প্রদেশ মন্ত্রী সুরেন্দ্র গুপ্ত ২৩ অক্টোবর ঘোষণা করেন যে দিল্লির ৩০টি জেলার নানা স্থানে তাঁরা স্টল বসাবেন, যেখানে “নির্ভরযোগ্য, বিশুদ্ধ ও উপযোগী” পূজার সামগ্রী বিক্রি হবে। তিনি জানান, হিন্দু দোকানদার, হকার ও ফেরিওয়ালারা নিরীক্ষা প্রক্রিয়ার পর এই ‘সনাতন প্রতিষ্ঠা’ স্টিকার পাবেন। নিরীক্ষার মানদণ্ড হিসেবে থাকবে দোকান বা স্টলের নথিভুক্তি, পরিচয়পত্র যাচাই এবং স্থানীয় প্রতিনিধির পরিদর্শন। ভিএইচপি দাবি করেছে, এই প্রক্রিয়া “গুণগত মান ও বিশুদ্ধতা” নিশ্চিত করবে।

    গুপ্ত বলেন, “এটি কারও বিরুদ্ধে নয়, বরং আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সনাতন বিশ্বাস রক্ষার প্রচেষ্টা। আমরা শান্তিপূর্ণ, আইনি ও স্বচ্ছভাবে কাজ করছি এবং সব সম্প্রদায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।” তবে ভিএইচপি-র পূর্ববর্তী কর্মকাণ্ড দেখায়, এই ধরনের প্রচারণার আসল উদ্দেশ্য ব্যবসায়ীদের ধর্মীয় পরিচয় অনুযায়ী ভাগ করা। ২০২৫ সালের জুলাই মাসে কানওয়ার যাত্রার সময় সংগঠনটি একই ধরনের ‘সনাতনি সার্টিফিকেশন’ অভিযান চালিয়েছিল, যেখানে শুধুমাত্র হিন্দু মালিকানাধীন দোকানে স্টিকার লাগানো হয়।

    ‘জিহাদি-মুক্ত দিল্লি’ ধারণা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সুরেন্দ্র গুপ্ত বলেন, “যারা জিহাদের উদ্দেশ্যে হিন্দু বোনদের প্রতি ভান করা সহানুভূতি দেখায়, যারা হিন্দু দেবদেবীর নামে রেস্তোরাঁ চালায় বা ‘থুথু জিহাদ’-এর মতো কাজে লিপ্ত—আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।” সাংবাদিকরা যখন জানতে চান, পূজার সামগ্রী বিক্রি করাকে কীভাবে জিহাদ বলা যায়, তখন গুপ্ত বলেন, “যদি কেউ আমাদের দেবদেবীতে বিশ্বাস না রাখে, আমাদের ধর্ম ও ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানকে অসম্মান করে, তবে সে কীভাবে আমাদের উৎসবে সামগ্রী বিক্রি করবে? যারা বিশ্বাস রাখে না, তারা অন্যত্র বিক্রি করুক। তারা আমাদের কাছ থেকে লাভ করতে চায়, অথচ তাদের ধর্ম এসবের বিরোধিতা করে—এই ভণ্ডামি আমরা মেনে নিতে পারি না।”

    গুপ্ত জানান, এই প্রচার কেবল উৎসবের সময় নয়, বরং সারা বছর চলবে। মন্দিরের বাইরে, বাজারে ও জনজীবনের নানা ক্ষেত্রে ভিএইচপি একইভাবে ‘সনাতন’ স্টিকার লাগানো দোকান থেকে কেনাকাটা করার আহ্বান জানাবে। ভবিষ্যতে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর ক্ষেত্রেও এই ‘সনাতন সার্টিফিকেশন’ বাধ্যতামূলক করা হবে বলেও তিনি ইঙ্গিত দেন।

    এটি নতুন কিছু নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো প্রায়শই ‘জিহাদি’ শব্দটি ব্যবহার করে পুরো মুসলিম জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্যবস্তু করেছে। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে ভিএইচপি ও বিজেপি নেতারা ‘জিহাদি-মুক্ত বাজার’ লেখা ব্যানার ঝুলিয়ে মুসলিম ব্যবসায়ীদের বাজার থেকে বের করে দেন। বিজেপি নেত্রী মালিনি গৌরের ছেলে একলব্য সিং গৌর প্রকাশ্যে হিন্দু ব্যবসায়ীদের মুসলিম কর্মচারীদের ছাঁটাই করতে বলেন এবং বাজার কমিটিগুলো তা মেনে চলে।

    এর আগেও নানা সময়ে ভিএইচপি ও বজরং দলের পক্ষ থেকে মুসলিম বাণিজ্য বয়কটের ডাক এসেছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে দিল্লির দিলশাদ গার্ডেনে বিজেপি সাংসদ প্রবেশ সাহিব সিং ভার্মা মুসলিমদের “সম্পূর্ণ বয়কট”-এর আহ্বান জানান। ২০২৩ সালে হরিয়ানায় হিংসার পর মুসলিম দোকানপাট ও কর্মীদের গ্রাম থেকে তাড়ানোর প্রচেষ্টা চলে। ২০২৪ সালে হিমাচল প্রদেশে মসজিদ ঘিরে সংঘর্ষের পর মুসলিম ব্যবসায়ীদের বয়কটের আহ্বান জানানো হয়। ২০২৫ সালের জুলাই মাসে কানওয়ার যাত্রার সময় দিল্লির পাঁচ হাজার দোকানে ‘সনাতনি’ স্টিকার লাগানো হয়, যেখানে মুসলিম মালিকানাধীন দোকানগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেওয়া হয়।

    এই বয়কট শুধু মুসলমানদেরই নয়, হিন্দু শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীকেও আঘাত করছে। পুনেতে মুসলিম বেকারি বন্ধ হওয়ার ফলে প্রায় চারশো শ্রমিক—হিন্দু ও মুসলিম উভয়ই—চাকরি হারিয়েছেন। এক হিন্দু বেকারি মালিক বলেন, “আমাদের পাঁচজন হিন্দু বিক্রেতা এখন বেকার। এটি কেবল ধর্মের বিষয় নয়, আমাদের জীবিকা ধ্বংসের বিষয়।”

    মানবাধিকারকর্মী হর্ষ মন্দার এই প্রবণতার তুলনা করেছেন নাৎসি জার্মানির ১৯৩০-এর দশকের ইহুদি ব্যবসায় বয়কটের সঙ্গে। তখন জার্মানিতে ইহুদিদের দোকানে ‘জুডে’ লেখা হলুদ তারকা লাগিয়ে তাদের চিহ্নিত করা হতো। ভারতের ক্ষেত্রে নাম ও পরিচয় থেকেই ধর্ম বোঝা যায়—যা মুসলিম দোকানদারদের সহজে টার্গেট করার উপায়ে পরিণত হয়েছে।

    ড. শামসুল ইসলাম বলেন, “নাৎসি জার্মানিতে ইহুদি ব্যবসা নিয়ন্ত্রিত ছিল, কিন্তু ভারতে এই বয়কট গরিব মুসলমানদের টার্গেট করছে—যারা ফল, সবজি, টফি, চুরন বা পুরনো কাপড় বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। বড় মুসলিম পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে কোনও  প্রতিবাদ নেই। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ নিজেই ইউএই'র মুসলিম ব্যবসায়ী ইউসুফ আলি-র মালিকানাধীন লুলু মল উদ্বোধন করেছেন।”

    সর্বোচ্চ আদালত ২০২৩ সালের এপ্রিলেই নির্দেশ দিয়েছিল যে ঘৃণা বক্তৃতার ক্ষেত্রে রাজ্যগুলোকে অভিযোগ ছাড়াই মামলা করতে হবে। তবুও ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত ভিএইচপি ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের প্রকাশ্য বয়কট অভিযানের আইনি প্রতিক্রিয়া কার্যত শূন্য। ফলে ভারতের সমাজে ধর্মভিত্তিক বিভাজন ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের রাজনীতি আরও গভীর হচ্ছে।
  • Link to this news (আজকাল)