• সন্তান কোলেই জঙ্গল রক্ষার চ্যালেঞ্জ! নতুন লড়াইয়ে বাল্যবিবাহ রুখে দেওয়া সেই ‘পোস্টার গার্ল’
    প্রতিদিন | ২৫ অক্টোবর ২০২৫
  • সুমিত বিশ্বাস, ঝালদা (পুরুলিয়া): এক হাজারটা বিড়ি বাঁধলে পাওয়া যেত ৪০ টাকা। ফলে ছয় ভাইবোনের সংসারে লেখাপড়াও ছিল বিলাসিতা। তাই প্রাথমিকভাবে অক্ষরজ্ঞান পর্যন্ত হয়নি। ন’-দশ বছর বয়স থেকেই ঘরের অভাব আর নিজের খিদে মেটাতে বিড়ি বাঁধত ছোট্ট রেখা। পরে প্রশাসনের নজরে এলে সেই সময় ন্যাশনাল চাইল্ড লেবার প্রজেক্ট স্কুলের আওতায় নিয়ে আসা হয় ১১ বছরের ওই বালিকাকে। কিন্তু তা আবার বাড়ির পছন্দ ছিল না। বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে তাদের এই এক রীতি। কিশোরী হওয়ার আগেই বসতে হবে বিয়ের পিঁড়িতে। কিন্তু বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে নাকচ করে পড়তে চায় রেখা। এভাবেই নিজের বাল্যবিবাহ রুখে দেশের রোল মডেল! একেবারে ‘পোস্টার গার্ল’। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি! এমনকি এখন পঞ্চম শ্রেণির পাঠক্রমেও তাঁর লড়াইয়ের কথা। এবার সেই রেখার জীবনে শুরু হল আরেক সংগ্রাম। ১৬ মাসের কন্যা সন্তানকে কোলে নিয়ে জঙ্গল বাঁচানোর সংগ্রাম। রীতিমতো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বন্যপ্রাণ রক্ষার এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে বালিকা রেখা থেকে ঘরের বধূ, মা, বনসহায়ক রেখা কালিন্দী।

    রেখার বয়স এখন ২৮। অনেক ঝড়-জল, প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে কাঠখড় পুড়িয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স। তারপর বনদপ্তরের অস্থায়ী কর্মী হিসেবে ঝালদা বনাঞ্চলের কলমা বিটে যোগদান। কলমা, কুদাগাড়া, ইছাহাতু, ছোট বকদ, কাঁসরা-র মতো বিস্তীর্ণ জঙ্গল জুড়ে লাঠি হাতে হেক্টরের পর হেক্টর বনাঞ্চল আগলে রেখেছেন ‘মা’ রেখা, আপন সন্তানের মতোই। ২০০৯ সালের ১৪ মে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা দেবী সিং পাটিল রেখাকে সম্মান জানিয়ে বলেছিলেন ‘সমাজ পরিবর্তনের দূত’। তারই বাস্তবায়ন যেন অক্ষরে অক্ষরে আজও পালন করে যাচ্ছেন রেখা, দেড় দশক পরেও। সকাল-দুপুর-সন্ধ্যায় জঙ্গলে লাঠি হাতে ডিউটি করতে করতে বোঝাচ্ছেন, এই বিশ্ব উষ্ণায়নের সময়ে বৃক্ষরোপন কতটা প্রয়োজন। চারপাশের জঙ্গলকে আগলে রাখতেই হবে। না হলে নিশ্চিত মৃত্যু।

    রেখার এই প্রচারে ওই কলমা বিটের বনাঞ্চল নির্ভর মানুষজন গবাদিপশুর জন্য গাছের পাতা কুড়াতে গেলেও ওই এলাকার কোন মানুষজনই আর গাছ কাটেন না। বন্যপ্রাণের ভয়ে আত্মরক্ষায় হাতে কুঠার থাকলেও তার কোপ পড়ে না গাছে। বনজ সম্পদ সংগ্রহ করেই বাড়ি ফিরে আসেন তাঁরা। তাই তো এখন কলমা বিটে ঘুরে বেড়ায় একাধিক কাঁকর হরিণ, চিতা, ভল্লুক। বুনো হাতির সঙ্গে উড়িয়ে দেওয়া যায় না রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের পদচারণাও।

    তাই রাজ্যের প্রধান মুখ্য বনপাল দেবল রায় বলেন, “সামাজিক কু’প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করে তিনি যে সাফল্য স্বীকৃতি পেয়েছেন। পরিবেশ রক্ষার কাজেও তিনি যাতে সেই স্বীকৃতি পান সেটাই চাই।” তাই একদিকে জঙ্গল বাঁচানো। সেইসঙ্গে বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে আজও তার প্রচার চলছে। চলছে সচেতনতার পাঠ। তাই এখনও প্রশাসন বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠানের তার ডাক পড়ে বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে তার লড়াইয়ের কাহিনী শোনাতে। নতুন প্রজন্মকে পরামর্শ দিতে। বনসহায়ক রেখার সঙ্গে জঙ্গল রক্ষার লড়াইয়ে গর্বিত তাঁর সহকর্মীরাও। কলমা বিটের বনসহায়ক সন্তোষ মাহাতো, ওয়াচার জগদীশ মাহাতো জুরেন মাহাতো বলেন, “আমরা গর্বিত যে রেখার সঙ্গে আমরা কাজ করতে পারছি। ডিউটির ফাঁকে তার কত যে লড়াইয়ের কথা আমরা শুনেছি। ওর ইচ্ছাশক্তি, কাজ শিক্ষণীয় বিষয়। ও আরও এগিয়ে যাক।”

    রেখার স্বামী মণীন্দ্র কালিন্দী জানান, “আমি চাষাবাদ করে কোনওক্রমে সংসার চালাই। তবে স্ত্রীর কাজে আমি সমস্তরকম ভাবে সাহায্য করি। আমি ওর কথা আগেই শুনেছিলাম। সংবাদপত্রে পড়েছিলাম। কিন্তু সে যে আমার স্ত্রী হবে, তা কোনদিনও ভাবিনি।” ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বনসহায়কের কাজ পেয়ে ২০২১-এ ঘর বাঁধে রেখা। ২০২৩ সালে ঝালদার জারগো কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে স্নাতক হন। প্রথমে জয়পুর রেঞ্জে কাজ করলেও বছর দুই ধরে ঝালদা বনাঞ্চলে রয়েছেন তিনি। কলমা বিটের ছোট বকদ গ্রামে তাঁর শ্বশুর বাড়ি। পাহাড়-জঙ্গল ছুঁয়ে থাকা গ্রামে হাতি এলেই বাঁশি বাজিয়ে সকলকে সতর্ক করে দেন লাঠি হাতে খাঁকি পোশাকের রেখা। তাঁর কথায়, “জঙ্গল রক্ষা, বন্যপ্রাণ বাঁচানো এখন আমার কাছে নতুন লড়াই। নতুন চ্যালেঞ্জ। এই কাজে আমি যেমন আমার স্বামীকে কাছে পাই, তেমনই আমার সহকর্মীদেরও। আমার শিশুকে তাঁরা মাঝেমধ্যেই কোলে নিয়ে আমাকে ডিউটিতে সহায়তা করেন। আমি চাই একটা মেয়েরও যাতে আর বাল্যবিবাহ না হয়।”

    আসলে রেখা নিজের পরিবারে দেখেছিলেন তাঁর দিদি জ্যোৎস্নাকে। তাঁর ১১ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় চারটে বাচ্চা নষ্ট হয়। তাই পরিবারের কথা না মেনে, রীতি ভেঙে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছিল তাঁর। ২০১০ সালে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে তাঁকে ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর’ করে। তাঁর লড়াইয়ের গল্প ফরাসি, ডাচ-সহ বিভিন্ন ভাষায় দুই মলাটে বন্দি হয়ে নানান নামে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিলেছে। পঞ্চম শ্রেণির ‘আমাদের পরিবেশ’ পাঠ্যপুস্তকের ১৮১ পৃষ্ঠায় জ্বলজ্বল করছে বালিকা রেখার ছবি ও তাঁর লড়াইয়ের কথা। আর সেই লড়াইয়ের সুফলেই কমছে বাল্যবিবাহ।
  • Link to this news (প্রতিদিন)