ভাইবোনের আইনি লড়াইয়ে জয়ী কোয়েল না কৌশিক? কেমন হলো ‘স্বার্থপর’?
এই সময় | ২৫ অক্টোবর ২০২৫
লাখ ছাড়িয়েছে সোনার ভরি। বাজারের যা হাল-হকিকত তাতে পাঁচশো লোক খাওয়াতে ন্যূনতম খরচ লাখ পাঁচেক। এর পরে ভাড়াবাড়ি, রকমারি পোশাক থেকে আনুষাঙ্গিক তালিকা তো রয়েইছে। সব মিলিয়ে আরও কয়েক লাখ খরচ তো রয়েইছে। এত জাঁকজমক করে বড় বাড়িতে বিয়ে দিয়েও কি শান্তি আছে? সেই বাবার সম্পত্তির দিকে নজর। বেচারা একটা মাত্র ভাই, কোথায় তাকে প্রাণখুলে সবটা দিয়ে যাবে তা নয়। চাহিদার শেষ নেই।
উপরের কথাগুলো ‘গল্প হলেও সত্যি’। ২০২৫ সালে দাঁড়িয়েও এই আলোচনা হয়। অনেক পরিবারেই হয়। প্রতিদিন হয়। সেই ছোটবেলায় যখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মায়ের শাড়ি গায়ে জড়িয়ে বিয়ের কনে সাজত মেয়েটা, তখন থেকে শুনেছে ‘একদিন তো পরের বাড়ি চলেই যাবি’। বড় হয়ে সেই পরের ঘরে যেতেও রক্ষে নেই, পান থেকে চুন খসলেই কেউ যেন জোরে ঝাঁকিয়ে বলে যাচ্ছে, ‘এসব ফুটুনি বাপেরবাড়ি গিয়ে করবে।’ এই বাপেরবাড়ি আর শ্বশুরবাড়ির মাঝে মেয়েদের জীবন বার বার দাঁড়িয়েছে প্রশ্নের মুখে। আদৌ কি নিজের বলতে মেয়েদের কিছু আছে?
শহরজুড়ে পোস্টার। বড় বড় হরফে লেখা ‘স্বার্থপর’। একঝলক দেখলে মনে হবে সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়ে বোনকে বিতাড়িত করছে দাদা? আইন যদিও বলে বাবা-মায়ের সম্পত্তিতে ছেলেমেয়ের সমানাধিকার। তবে কীসের এই দোলাচল? কেস ঠুকে দিলেই তো ল্যাটা চুকে যায়। সত্যিই কি আদালতে জীবনের সব সমস্যার সমাধান হয়? বহু ঝগড়া, অভিমান, লড়াই, বিচ্ছেদ যন্ত্রণার মাঝেও কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কাছের মানুষের জন্য বুক কেঁপে ওঠে। এতটা ‘স্বার্থপর’ কি সবক্ষেত্রে হওয়া যায়?
কোয়েল মল্লিক ও কৌশিক সেন। ভাইবোনের নিপাট ভালোবাসার গল্প ‘স্বার্থপর’। দাদা সৌরভ (কৌশিক সেন) এবং বোন অপর্ণা (কোয়েল মল্লিক) চোখে হারায় একে অন্যকে। তবে ভাইবোনের মধ্যে সংঘাত বাঁধে অপর্ণার অনুমতি ছাড়াই বাবার সম্পত্তির অধিকার থেকে সৌরভের বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত। যে বাড়িতে ছোট থেকে বড় হয়েছে, যেখানে পা রাখতেই স্মৃতির পাহাড়। সেই পৈতৃক ভিটের উপর নিজের অধিকার ছাড়তে নারাজ অপর্ণা।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বরাবরই নারীদের ‘অপশন ২’ করে রেখে দেওয়ার পক্ষে। তাই বাবার বাড়ির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার অধিকার একমাত্র ছেলের, এমনটা ভেবে নেওয়ায় কোনও রকম কার্পণ্য থাকে না। ‘স্বার্থপর’ও ঠিক যেন সেই ছবি। এই ছবির গল্প বহু পরিবারের। তবু এই চেনা ছকের কিছু মোড় অবাক করবে সকলকে। দাদার স্ত্রী মানেই খারাপ, আর জামাই মানেই ‘নিজের ভাগ বুঝে নাও’ এমনটা সবক্ষেত্রে নাও হতে পারে। তাই ভাইবোনের এই লড়াইয়ে তারা কেবলই দর্শক।
আইন, আদালত, মামলা-মোকদ্দমা সবকিছু থাকলেও, পরিচালক বুদ্ধি করে সবচেয়ে কঠিন কাজ দিয়েছেন দর্শককে। ভাবছেন তো দর্শক শুধু সিনেমা দেখবে, তার আবার সহজ, কঠিন কী? যে যুক্তি, পাল্টা যুক্তির বুননে আমরা সকলে আটকে। যেখানে মন বলে এক কথা, আর মাথা সম্পূর্ণ বিপরীত। সিনেমা হল-এ বসে ২ ঘণ্টা ১৫ মিনিট প্রতিটি অভিনেতার অভিনয় দেখে বিচার করা কঠিন কাকে ছাপিয়ে কে এগিয়ে গেল। এ বলে আমায় দ্যাখ, তো ও বলে আমায়। ভাইবোনের এই জুটি বহুদিন মনে থেকে যাবে দর্শকের। অনেকদিন বাদে আবারও নিজের সেরাটা দিলেন কোয়েল। ভক্তেরা তো এ ভাবেই দেখতে চায় টলি ক্যুইনকে।
ইন্ডাস্ট্রির ‘বেল্ট ম্যান’ নামে পরিচিত রঞ্জিত মল্লিক এই সিনেমায় একেবারে ‘চাবুক’। দীর্ঘদিন পরে মাঠে নেমেও বল আউট অফ বাউন্ডারি পাঠিয়েছেন তিনি। অনির্বাণ চক্রবর্তীও বরাবরের মতো চোখ সরাতে দেননি পর্দা থেকে। পাছে তাঁর এক্সপ্রেশন মিস হয়ে যায়। কোয়েলের বিপরীতে অভিনেতা ইন্দ্রজিৎ চক্রবর্তীও বেশ ইন্টারেস্টিং। তাঁকে এমন ভূমিকায় খুব কমই দেখেছে দর্শক। তবে এই সিনেমায় সবচেয়ে প্রাপ্তি শুরু থেকে শেষ গান। জিৎ গঙ্গোপাধ্যায় আবারও যেন চেনা ছকে।
প্রথম ছবি হিসেবে পরিচালক অন্নপূর্ণা বসুর গল্প বলার ধরন সত্যিই প্রশংসনীয়। সিনেমা দেখতে দেখতে একটা প্রশ্নই বার বার ঘুরে-ফিরে এসেছে মনে। অপর্ণাদের স্বপ্নপূরণ করতে আজও কেন কাঁধ লাগে? আজও কেন কিছু ক্ষেত্রে জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের গণ্ডি পেরিয়ে নিজের রোজগারে সিঙ্গল হচ্ছে না হিসেব-নিকেশ? কেন মেয়েদের সমানাধিকার বুঝে নিতে আদালতের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে? এই উত্তর হয়তো কোনও সিনেমার চিত্রনাট্যে পাওয়া সম্ভব নয়, অপেক্ষা করতে হবে সময়ের। তবু সবমিলিয়ে উৎসবের আবহে সপরিবারে ‘স্বার্থপর’ দেখলে মন্দ লাগবে না।