• রূঢ় বাস্তবের বিরুদ্ধে কঠিন লড়াই বেলডাঙার 'কাঙালি'র
    এই সময় | ২৬ অক্টোবর ২০২৫
  • শুভাশিস সৈয়দ, বেলডাঙা

    'অভাগীর স্বর্গ' গল্পে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লেখেন- 'মা কহিল, কাঙালি, আজ তোর আর কাজে গিয়ে কাজ নেই। কাজ কামাই করিবার প্রস্তাব কাঙালির খুব ভাল লাগিল, কিন্তু কহিল, জলপানির পয়সা দুটো ত তা হলে দেবে না মা...!'

    বাস্তবের 'কাঙালি' মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার এক নাবালক। গল্পের কাঙালির থেকে বছর পাঁচেকের ছোট। ১০ বছরের ছেলেটি এক বেলা ব্যাগ বিক্রি করতে না গেলে, সেই দিন বাড়িতে উনুন জ্বলে না। রূঢ় বাস্তবের কাছে পরাজিত হয়ে সে চায় জীবনের রূপকথা লিখতে। তাই ঘুম থেকে উঠে রোজ সকালে খালি পেটে বেরিয়ে যায় গ্রামে ব্যাগ ফেরি করতে। তার বাড়ি থুড়ি ভাড়া বাড়ি মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙা পুরসভা এলাকায়। মা জানান, প্রতিদিন সকাল সাতটায় ফেরি করতে যায় ছেলে। ১০টা নাগাদ বাড়ি ফিরে স্কুল যায়। বিকেলে বাড়ি ফিরে আবার যায় ফেরিতে। দিনে হাজার টাকার ব্যাগ বিক্রি হলে তবেই ১৫০-২০০ টাকা আয় হয়। কিন্তু ফেরির চক্করে চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়ার পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে বলে আফশোস করেন মা। তিনি বলেন, 'টাকার অভাবে ছেলেকে গৃহশিক্ষক দিতে পারিনি। সংসার চালাতে গিয়ে ওর পড়াশোনারও ক্ষতি হচ্ছে।'

    নাবালকের মা ছিলেন আনাজ বিক্রেতা। তখন অর্থকষ্ট সে রকম ছিল না। বছর খানেক আগে আনাজ বিক্রি করে বাড়ি ফেরার পথে দুর্ঘটনায় ডান পায়ের হাঁটুর নীচ থেকে গোড়ালি পর্যন্ত অংশের হাড় ভেঙে টুকরো হয়ে যায়। মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দু'বার অস্ত্রোপচার হয়েছে। এখনও স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারেন না। বসতেও পারেন না হাঁটু মুড়ে। রান্নাটুকু করেন কোনও মতে। দুর্ঘটনার পরে কার্যত 'অক্ষম' হওয়ায় মুখ ফিরিয়েছেন তাঁর স্বামীও। ফলে মা-ছেলের সংসারে নেমে আসে আঁধার। মা বলেন, 'বিদ্যুৎ নিয়ে মাসে বাড়ি ভাড়া ১৫০০ টাকা। আমার ওষুধ ও খাওয়া খরচ নিয়ে সংসার চালাতে পারছি না। ধার-দেনা করে কতদিন।'

    এই অবস্থায় বাড়ির কাছে একটি ব্যাগ তৈরির কারখানার মালিক ধারে ব্যাগ ফেরি করার জন্য দেন। কারখানায় কর্মরত এক মহিলা কাজ ছেড়ে যাওয়ার আগে তাঁর ব্যবহার করা সাইকেল দেন ওই নাবালককে। আর কারখানা মালিক কিনে দিয়েছেন 'ব্লু-টুথ মাইক'। সেই মাইকের প্রচার শুনে গ্রামের মহিলারা ভিড় করেন ছোট ছেলেটির সামনে। নাবালকের কথায়, 'ঘুম থেকে উঠে বই নিয়ে বসতে পারি না। সাইকেলের হ্যান্ডেলে ব্যাগ সাজিয়ে বেরিয়ে পড়ি। ভাল লাগে না। কিন্তু কাজ না করলে খাব কী। মায়ের ওষুধ কেনার খরচ পাব কোথায়।'

    তার সংযোজন, 'আমারও ইচ্ছে করে বেলা করে ঘুম থেকে উঠতে। স্কুল থেকে ফিরে সবাই যখন মাঠে খেলে, তখন আমি সাইকেল নিয়ে ব্যাগ ফেরি করি।' বালকের পরিবারের কাহিনি শুনে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছেন বেলডাঙা ও পলাশির বেশ কয়েক জন যুবক। তাঁদের অন্যতম ওসমান গনি বলেন, 'ছেলেটির মায়ের পায়ে আরও একটি অস্ত্রোপচারের দায়িত্ব আমি নিয়েছি। মাসের ঘর ভাড়া ও ছেলেটির ব্যবসার সামগ্রী কেনার ভারও নিয়েছি।' বেলডাঙার এই বালকের মতো নাবালকদের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের 'মিশন বাৎসল্য' প্রকল্প রয়েছে। ওই প্রকল্পের আওতায় প্রতি মাসে চার হাজার টাকা দেওয়া হয় সরকারের তরফে। এ ব্যাপারে মুর্শিদাবাদ জেলা শিশুসুরক্ষা আধিকারিক অর্জুন দত্ত বলেন, 'প্রকল্পের আওতায় মুর্শিদাবাদ জেলায় ৩৮৫ জন নিয়মিত চার হাজার টাকা করে পায়। ওই নাবালকের ব্যাপারে আমাদের কেউ জানায়নি। এ ক্ষেত্রে নাবালকের মাকে আমাদের কাছে লিখিত আবেদন করতে হবে। সেই মতো তদন্ত করে রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রকল্পের আওতায় নাম তালিকা ভুক্ত করা হবে।'

    অর্জুন জানান পকসো আইনে ভুক্তভোগী, সংশোধনাগারে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তদের সন্তান, উদ্ধার হওয়া শিশুশ্রমিক, স্বামী ছেড়ে চলে গিয়েছেন এমন মায়ের সন্তান, অনাথ শিশু, এমনকী কোভিডে মৃত্যু হয়েছে বাবা বা মায়ের সেই সন্তানও এই সুবিধে পেতে পারেন। বেলডাঙার বিধায়ক তৃণমূলের হাসানুজ্জামান শেখ বলেন, 'ওই পরিবারের কষ্টের কথা শুনেছি। চেষ্টা করছি 'মিশন বাৎসল্য' প্রকল্পে ওই নাবালককে অর্থ সাহায্য করার।'

  • Link to this news (এই সময়)