• রামায়ণ-মহাভারতের যুগেও হয়েছিল ছট পূজা, জেনে নিন এই গল্পগুলি
    আজকাল | ২৭ অক্টোবর ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক: ছট পূজা হল সূর্যদেব এবং তাঁর পত্নী ঊষা দেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত এক প্রাচীন হিন্দু আচার, যা আজও গভীর ভক্তি ও সাংস্কৃতিক মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়। বিশেষত বিহার, ঝাড়খণ্ড, পূর্ব উত্তরপ্রদেশ এবং নেপালের তরাই অঞ্চলে এই উৎসবটি অসীম শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করা হয়। যদিও আজকের ছট পূজার রীতিনীতিগুলি সুপ্রতিষ্ঠিত ও সংগঠিত রূপ পেয়েছে, এর মূল সূত্র নিহিত রয়েছে প্রাচীন হিন্দু গ্রন্থসমূহে — বিশেষত রামায়ণ ও মহাভারতে। এই মহাকাব্যগুলির মধ্যে থাকা সূর্যোপাসনার আখ্যান ও অনুশীলনই পরবর্তীতে বর্তমান ছট পূজার রূপে বিকশিত হয়েছে।

    রামায়ণে সীতার সূর্য উপাসনারামায়ণ অনুযায়ী, লঙ্কা থেকে বিজয়ী হয়ে ভগবান রাম যখন অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করেন, তখন রাজ্যজুড়ে দীপাবলি উদ্‌যাপন হয়। সেই দীপাবলির ষষ্ঠ দিনে মাতা সীতা সূর্যদেবের উপাসনা ও উপবাস করেন মাতৃত্বের আশীর্বাদ প্রার্থনার উদ্দেশ্যে। বিশ্বাস করা হয়, এই পূজার ফলেই তাঁর গর্ভে জন্ম নেন লব ও কুশ। বিহারের মুঙ্গের জেলার সীতা চরণ মন্দির এই ঐতিহাসিক উপাসনার স্থান বলে মনে করা হয়। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, ছট পূজার শিকড় বহু প্রাচীন — রামায়ণের যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত।

    মহাভারতে কুন্তীর আচারমহাভারত গ্রন্থেও সূর্য উপাসনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ পাওয়া যায়। যখন পাণ্ডবরা লাক্ষাগৃহের অগ্নিকাণ্ড থেকে পালিয়ে রক্ষা পান, তখন তাঁদের মা কুন্তী পুত্রদের মঙ্গল ও রক্ষার জন্য সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে এক বিশেষ পূজা করেন। এই উপাসনাকে অনেকেই ছট পূজার প্রাচীনতম রূপ বলে মনে করেন। তদুপরি, কর্ণ, যিনি সূর্যদেব ও কুন্তীর পুত্র, তিনিও সূর্য উপাসনা করতেন বলে শাস্ত্রে উল্লেখ আছে। ফলে সূর্যদেবের সঙ্গে এই উৎসবের সম্পর্ক আরও গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

    দ্রৌপদীর আশীর্বাদ প্রার্থনামহাভারতের আরেকটি কাহিনিতে দেখা যায়, দ্রৌপদী নকদি গ্রামের (বর্তমান রাঁচি, ঝাড়খণ্ড) এক প্রস্রবণের ধারে সূর্য উপাসনা করেন। তিনি এই উপাসনার মাধ্যমে দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করেন যাতে তাঁর স্বামীরা, পাণ্ডবরা, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে বিজয় অর্জন করতে পারেন। এই ঘটনাটি ছট পূজার আরেকটি প্রতীকী দিক তুলে ধরে— দৈব আশীর্বাদ ও সফলতার জন্য সূর্য উপাসনা।

    ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণে উল্লেখহিন্দু ধর্মগ্রন্থ ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণ-এ ছট পূজা এবং ছঠী মাইয়া-র উপাসনার বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। বলা হয়, গহাদবল রাজবংশের আমলে বারাণসী থেকে এই উপাসনার প্রচলন শুরু হয় এবং পরবর্তীতে তা বিহার, ঝাড়খণ্ড ও পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। পুরাণটি স্পষ্টভাবে দেখায় যে ছট পূজা কেবল একটি আঞ্চলিক উৎসব নয়, বরং প্রাচীন হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

    ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতারামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণসমূহে ছট পূজার বিভিন্ন রূপে উল্লেখ এই উৎসবের দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারের সাক্ষ্য দেয়। যুগে যুগে রীতি ও আচার পাল্টালেও মূল ভাব—সূর্যের শক্তি, আলোক ও জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞতা—অপরিবর্তিত রয়েছে। আজও নদীতীরে দাঁড়িয়ে ভক্তরা অস্ত ও উদীয়মান সূর্যকে অর্ঘ্য দেন, যেমন হাজার বছর আগে সীতা, কুন্তী ও দ্রৌপদী করেছিলেন।

    ছট পূজা তাই কেবল এক উৎসব নয়, বরং মানবতার প্রাচীন কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এক চিরন্তন প্রতীক, যা প্রমাণ করে—ঐতিহ্যের শক্তি সময়কেও অতিক্রম করতে পারে।
  • Link to this news (আজকাল)