মণ্ডপে মণ্ডপে বিশাল জগদ্ধাত্রী প্রতিমার চক্ষুদান করছে বছর সতেরোর এক কিশোরী। চন্দননগরে এ বার এই দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়িয়েছেন অনেকেই। সময় বদলেছে। সমাজে ক্রমশই নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করছেন মহিলারা। তবে, দেবীর চক্ষুদান! সচরাচর এমনটা দেখা যায় না।
‘‘এ বার তো প্রথম নয়। পাঁচ বছর ধরে করছি। এখন আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়েছে। তবে, এ বার সবচেয়ে বেশি প্রতিমার চক্ষুদান করেছি। ১৮টির।’’— বলছে মৌপিয়া পাল নামে উত্তর চন্দননগরের গড়বাটীর বাসিন্দা, কৃষ্ণভাবিনী নারী শিক্ষা মন্দিরের কলা বিভাগের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রীটি। পড়াশোনার পাশাপাশি নিয়মিত সে আঁকাও শেখে।
মৌপিয়ার বাবা মুক্তি শহরের নামী মৃৎশিল্পী। ছোট থেকেই ঘরের কোণে কাদা, খড়, খড়িমাটি ও তুলির গন্ধে বড় হয়েছে সে। বাবার কাজ দেখতে দেখতে গড়ে তুলেছে নিজের আগ্রহ। মাত্র ১২ বছর বয়সে প্রথমবার জগদ্ধাত্রীর চক্ষুদানের কাজ হাতে নেয় মৌপিয়া। তারপর থেকেই পাড়ায় পাড়ায় তার নাম ছড়ায়। এ বার বাবার তৈরি ১৮টি প্রতিমারই সে চোখ আঁকে।
মুক্তি বলেন, ‘‘মেয়ে চক্ষুদান করায় আমার অনেকটাই সুবিধে হয়। তবে, সবচেয়ে ভাল লাগে যখন অনেকেই বলেন, বাবার চেয়েও মেয়ে এগিয়ে।’’ এই কাজে কখনও কোনও আপত্তি? মৌপিয়া বলে, ‘‘মেয়ে বলে দেবীর চক্ষুদান নিয়ে এপর্যন্ত কোনও পুজো কমিটি আপত্তি জানায়নি। কারও আপত্তি থাকলে কি এত প্রতিমার কাজ করতে পারতাম? বাবাই অনুপ্রেরণা। এখনচোখ আঁকার সময় মনে হয়, আমি যেন নিজের মাকে দৃষ্টি দিচ্ছি! এটাই আনন্দের।”
মৌপিয়ার স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা রূপা ঘোষ জানান, চলতি বছর স্কুলের সরস্বতী প্রতিমাও তাঁদের প্রিয় ছাত্রীটি নিজের হাতে গড়েছিল। তিনি বলেন, ‘‘আমি অমন অপরূপ প্রতিমা সত্যিই দেখিনি। মৌপিয়া পড়াশোনায় সাধারণ, কিন্তু চক্ষুদানে অসাধারণ। ও আমাদের গর্ব। ওর মধ্যে থাকা নারীশক্তিরই এ যেন আর এক প্রকাশ।”
মগরার বাগাটি শ্রীগোপাল ব্যানার্জি কলেজের দর্শনের প্রাক্তন শিক্ষিকা ঊর্মিলা দাশগুপ্ত মনে করেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের সব কাজে সুযোগ দেওয়া হয় না। এখনও পুরুষের আর নারীদের কাজ আলাদা— এমন ভ্রান্ত ধারণা কিছু ক্ষেত্রে রয়ে গিয়েছে। ফলে, আগে বহু পুরুষ মৃৎশিল্পীর কাজে স্ত্রীরা সহযোগিতা করলেও চক্ষুদানের অধিকার পেতেন না। এখন সেটা কমেছে। তাই মৌপিয়ারা চক্ষুদান করতে পারছে। সুযোগ পেলে অনেক মৌপিয়া নিজের শিল্পীসত্তার প্রকাশ ঘটাতে পারে।