• ক্রমশই মন্থর হচ্ছে মহানগরের রাস্তা, সড়কপথে নিত্য নাজেহাল কলকাতাবাসী, বছরে মোট কত দিন শুধু সিগন্যালে থেমে নষ্ট?
    আনন্দবাজার | ২৭ অক্টোবর ২০২৫
  • কলকাতা কেন লন্ডন হয়নি, সে প্রশ্ন এখন রাজনীতির রসদ। কিন্তু আপাতত লন্ডনের বাসিন্দারা অনায়াসে উল্টো প্রশ্ন তুলতে পারেন— লন্ডন কেন কলকাতা হয়ে উঠছে? গতিমন্থরতার নিরিখে। কলকাতার বিভিন্ন সড়কে যানবাহনের গতি ক্রমশ মন্থর হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সমীক্ষা তেমনই বলছে।

    পৃথিবীর ৬২টি দেশের ৫০১টি বড় শহরে যান চলাচলের ‘গড় গতি’ পরিমাপ করে ‘টমটম ট্র্যাফিক ইনডেক্স’। তাদের সমীক্ষার ফলাফল বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে মন্থর পাঁচটি মহানগরের তালিকায় তিনটিই ভারতীয়। কলকাতা, বেঙ্গালুরু এবং পুণে। কলকাতায় এখন ১০ কিলোমিটার পথ পেরোতে গড়ে ৩৪ মিনিট ৩৩ সেকেন্ড সময় লাগে। গড় গতি ঘণ্টায় ১৭.৪ কিলোমিটার। বেঙ্গালুরুতে সেই ১০ কিলোমিটার যেতে লাগে ৩৪ মিনিট ১০ সেকেন্ড। পুণেতে ৩৩ মিনিট ২২ সেকেন্ড। গোটা পৃথিবীর নিরিখে ভারতের এই তিন শহর যথাক্রমে দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ স্থানে। প্রথম স্থানে বারাঙ্কিয়া। যে শহর দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের কলম্বিয়ায়। অর্থাৎ, এশিয়ায় আপাতত কলকাতাই ‘মন্থরতম’।

    এই তালিকায় পঞ্চম স্থানে রয়েছে লন্ডন। ব্রিটেনের রাজধানী ইউরোপের একমাত্র শহর, যা এই মন্থরতার তালিকায় প্রথম পাঁচে স্থান পেয়েছে। লন্ডনে ইদানীং ১০ কিলোমিটার পথ পেরোতে গড়ে লাগছে ৩৩ মিনিট ১৭ সেকেন্ড। হায়দরাবাদ, চেন্নাই, মুম্বইয়ে ১০ কিলোমিটার রাস্তা পেরোতে লাগছে ২৯ থেকে ৩২ মিনিট করে। তবে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি। ২০২৪ সালের (সাম্প্রতিকতম) সমীক্ষা অনুযায়ী দিল্লিতে ২৩ মিনিটে ১০ কিলোমিটার অতিক্রম করা যায়।

    বছরে কত সময় নষ্ট?

    ওই আন্তর্জাতিক সমীক্ষা বলছে, কলকাতায় দিনের ব্যস্ত সময়টুকুর হিসাব কষলেই বছরে মাথাপিছু সময় নষ্ট ১১০ ঘণ্টা। অর্থাৎ, সাড়ে চার দিন। ভারতীয় সংস্থা ‘সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’-এর সমীক্ষা বলছে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। প্রত্যেক শহুরে ভারতবাসীকে সপ্তাহে গড়ে ৭ থেকে ১০ ঘণ্টা সময় যাতায়াতের পথেই কাটাতে হয়। বছরে কমবেশি ৫০০ ঘণ্টা। অর্থাৎ, ৩৬৫ দিনের মধ্যে মোট ২০ দিন কেটে যায় রাস্তায় সবুজ আলো দেখার অপেক্ষায়।

    ব্যধির চেয়ে আধি বড়!

    অভিজ্ঞ আধিকারিকেরা বলছেন পুর-আইনে দুর্বলতার কথা। সাধারণ ভাবে কোনও বহুতলে বা আবাসন চত্বরে পরিবারপিছু একটি করে গাড়ি থাকতে পারে বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে পরিবারপিছু তিন-চারটি গাড়ি থাকে। এ বিষয়ে পুর আইনে স্পষ্ট নির্দেশিকা থাকলে পরিস্থিতি আলাদা হত বলে অনেকে মনে করছেন। কলকাতা এবং বৃহত্তর কলকাতার পদস্থ প্রশাসনিক কর্তা হিসাবে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একাধিক আধিকারিক আবার বলছেন সিঙ্গাপুরের কথা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ওই ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রে চাইলেই গাড়ি কেনা যায় না। সেখানে গাড়ির উৎপাদন এবং বিক্রি ‘নিয়ন্ত্রিত’। নিলামের মাধ্যমে গাড়ি বাজারে ছাড়া হয়। পশ্চিমবঙ্গের এক পদস্থ আমলার কথায়, ‘‘অনেকে প্রশ্ন তুলবেন, স্বাধীন ভাবে সম্পত্তি ক্রয়ের অধিকার থেকে নাগরিক কেন বঞ্চিত হবেন? কিন্তু শহরের পরিকাঠামোর সঙ্গে যানবাহন সংখ্যার সামঞ্জস্য বজায় রাখতে এই ব্যবস্থা জরুরি।’’ কিন্তু যাঁরা বলছেন, তাঁরাও জানেন, এই বস্তু সোনার পাথরবাটির মতোই অসম্ভব। বিশেষত, যেখানে গাড়ি হল সামাজিক সম্মানের সূচক। যাঁর যত গাড়ি, তাঁর গুরুত্ব তত বেশি।

    আসলের সঙ্গে সুদ!

    একেই তো শহরের গতি মন্থর থেকে মন্থরতর হচ্ছে। তার উপর গত কয়েক বছর ধরে কলকাতার রাস্তায় বেড়েছে গার্ডরেলের ‘দাপট’। দুর্ঘটনা কমাতে ‘গতি নিয়ন্ত্রণ’ করতে যত্রতত্র গার্ডরেল বসিয়েছে পুলিশ। এই গার্ডরেলের আবির্ভাব ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’ প্রকল্পের পিছু পিছু। গাড়ির গতি কম থাকলে দুর্ঘটনা ঘটবে না। দুর্ঘটনা ঘটলেও তার অভিঘাত কম হবে, এমনই ছিল পরিকল্পনা। তাতে হয়তো দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান কমেছে। কিন্তু হয়রানি বেড়েছে বহুগুণ। গতিসীমা মানার অভ্যাস যাঁদের নেই, তাঁরা সামান্য সুযোগেই গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেন এবং গার্ডরেলের কাছে পৌঁছে আচমকা ব্রেক কষেন! তাতে বিপদ বাড়ে। অনেক সময় ফাঁকা রাস্তায় দ্রুতগতিতে চলতে গিয়ে সেই গতিতেই গার্ডরেল কাটিয়ে বেরোতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। যত্রতত্র চাকা লাগানো গার্ডরেল বসিয়ে দেওয়ায় যান নিয়ন্ত্রণে পুলিশের সুবিধা হয় বটে। কিন্তু রাতের দিকে সেগুলি বেওয়ারিশ হয়ে পড়ে থাকায় গাড়ি চলাচলে আরও সমস্যা তৈরি হয়।

    সমাধান কোন পথে?

    রাজ্যের উচ্চপদস্থ আমলাদের একাংশে মনে করেন, গণপরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতি হলে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমবে। তাঁদের মধ্যে এক জনের বক্তব্য, ‘‘বামফ্রন্ট আমলে সিএসটিসির বাস নিত্যযাত্রীদের বড় ভরসা ছিল। পরবর্তীকালে সেই ব্যবস্থা দুর্বল হয়েছে।’’ তিনিই জানাচ্ছেন, কেন্দ্রে ইউপিএ সরকারের আমলে জেএনএনইউআরএম প্রকল্পের আওতায় দেশের বড় শহরগুলিতে আধুনিক বাস চালানোর ব্যবস্থা হয়েছিল। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিষেবাও শুরু হয়েছিল। ফলে উচ্চ উপার্জনের শ্রেণিও বাসে যাতায়াত শুরু করেছিল। কলকাতার গণপরিহণ ব্যবস্থার অবনতির জন্যও অবশ্য তিনি বামেদেরই দায়ী করছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমাদের রাজ্যে দীর্ঘ বাম শাসনের কারণে একটা মেকি বামপন্থী মানসিকতা রয়েছে। এখানে বাসের ভাড়া কিছুতেই বাড়ানো যায় না।’’ ভাড়া বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে পরিবহণ দফতরের কোনও আধিকারিকই প্রকাশ্যে মুখ খুলতে রাজি নন। কিন্তু অনেকেই সহমত যে, প্রয়োজন মতো ভাড়া না-বাড়লে বেসরকারি বাসমালিকেরাও পর্যাপ্ত বাস রাস্তায় নামাবেন না। ফলে গণপরিবহণ ব্যবস্থা আরও পঙ্গু হবে। আরও বেশি নাগরিকেরা প্রাইভেট গাড়ি-নির্ভর হবেন এবং তাতে শহরের রাস্তায় যানজট আরও বাড়বে।

    লাইফ ইন আ মেট্রো!

    রাজ্য প্রশাসনের একটি অংশের আশা, কলকাতার সড়কে যানবাহনের গড় গতির ছবি পরবর্তী সমীক্ষায় বদলাবে। কারণ, মেট্রো পরিষেবার সম্প্রসারণ। গত অগস্ট মাস থেকে কলকাতায় তিনটি নতুন যাত্রাপথে মেট্রো চলাচল শুরু হয়েছে। আগের চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী মেট্রোয় যাতায়াত করছেন। আগামী কয়েক মাসে কলকাতা মেট্রোর আরও কয়েকটি পথ পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে যাওয়ার কথা। তখন রাস্তায় সামগ্রিক ভাবে গাড়ির সংখ্যা কমবে। বস্তুত, দেশের অন্যান্য শহরেও সড়কের গতি বাড়াতে মেট্রো সম্প্রসারণ বড় ভূমিকা নিচ্ছে এবং নিতে চলেছে। নয়াদিল্লিতে মেট্রো পরিষেবা আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। সেখানে অসংখ্য নিত্যযাত্রী নাগরিক বাড়িতে গাড়ি রেখে মেট্রোয় দূরদূরান্তে যাতায়াত করেন। তবে সে মেট্রোর ভাড়াও তার স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা হয়েছে। ‘মেকি বামপন্থী’ মানসিকতার শহর সেই ভাড়া মানবে কি না, তা-ও দেখার।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)